আধুনিক জীবনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক গভীর। একালে বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে কেউ চলতে পারে না। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উপায় হিসাবে বিজ্ঞান আমাদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারে। বিজ্ঞান শব্দের বৈজ্ঞানিক অর্থ যা-ই হোক না কেন, বিজ্ঞান যে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অর্থে বিজ্ঞান আমাদের সংস্কৃতির অংশ। মানুষের বিবেক, নৈতিকতা ও সততা বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। যেহেতু বিজ্ঞান যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই একমাত্র বিজ্ঞানই পারে মানুষের বোধ ও বুদ্ধিকে শাণিত করতে। যুক্তিসঙ্গত মানবীয় আচরণ মানেই বিজ্ঞানসম্মত আচরণ। মানুষের সাথে মানুষের সংহতি ও মৈত্রীর বন্ধন সৃষ্টিতে বিজ্ঞান সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সুতরাং আধুনিক জীবনের মানবীয় বন্ধন সৃষ্টি করতে হলে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে বিজ্ঞানের সুশীতল ছায়াতলে। কারণ বিজ্ঞান জীবন ও জগতের অস্পষ্টতা দূর করতে পারে। বিজ্ঞান এখন যুক্তির জালে রহস্যময় জীবনকে ঘিরে ফেলেছে। এখন অলৌকিকতা, কাল্পনিকতা ও রহস্যময় জীবন বলে কিছু নেই। প্রকৃতির সব বিষয় এখন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আওতাভুক্ত। আমরা যদি বিজ্ঞানকে একবার আমাদের সংস্কৃতির অংশ করে নিতে পারি, তবে বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক ব্যবহার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে যুদ্ধ বাধিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করার পথ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই কারণেই আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি বিজ্ঞানকে সংস্কৃতির প্রধান উপাদান বলে বিবেচনা করেন।
বিজ্ঞানের সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারণা সহজেই অনুমেয়। বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ তথ্য, প্রয়োগিক কৌশল ছাড়াও সামাজিক সাংস্কৃতিক অংশের একটি মৌলিক উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে। কারণ বিজ্ঞান একটি নৈর্ব্যক্তিক ধারণা। প্রাকৃতিক রহস্যের জটিল ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ বিজ্ঞান দ্বারা সাধিত হয়। আসলে প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের মানবিক প্রেরণা থেকেই বিজ্ঞানের জন্ম হয়। মানুষের মস্তিষ্ক ও প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ নতুন একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন সৃষ্টি করে। মানুষ যে একদিন বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হবে, প্রকৃতি তার বড় উদাহরণ। প্রকৃতির ফুল, পাখির কলরব, নদীর গতিপ্রকৃতি ও প্রবাহ মানুষের সাথে মানুষের আত্মিক সহযোগিতার ধারণার মধ্যে একটি কৌতূহল থেকেই জন্ম নেয় বিজ্ঞানের আদিম ধারণা। সুতরাং বিজ্ঞান প্রকৃতিতে সব সময় ছিল। মানুষ এখন বিজ্ঞানকে সিনথেটিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার নতুন রূপ আবিষ্কার করছে মাত্র।
আমাদের দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত প্রাচীন ও ঐশ্বর্যপূর্ণ। আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশ্ববিজ্ঞানের জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বোস। এই সব বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিশ্বখ্যাতির অধিকারী। আমাদের বিজ্ঞান-ভাবনা শুরু হয় উনিশ শতকের মধ্যভাগে। এই সময় আমাদের ছিল না কোনো বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। মহামনীষী অক্ষয় কুমার দত্ত এই কঠিন পরিভাষা সৃষ্টির কাজ করেন।
বিজ্ঞানকে যদি আমরা সংস্কৃতির অংশ করে নিই, তবে বিদ্যালয়-বহির্ভূত বিজ্ঞানচর্চা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দিতে পারে। চিরকালীন বিজ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ায় একাডেমিক বিজ্ঞানচর্চা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারেনি। চিরকালীন বিজ্ঞানচর্চার ধারণা এখন নতুন করে আমাদের বিজ্ঞান আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে যুক্তির জালে আবদ্ধ করে তার বিচারশক্তিকে প্রখর করে তুলতে হবে। এর জন্য সকলকে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার দরকার নেই বিজ্ঞানের গুরুত্ব বোঝার আগ্রহটাই যথেষ্ট।
সমাজে ও রাষ্ট্রের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে যারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে ব্যবহার করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা এখনও বিজ্ঞানকে কেবল করে-খাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন। বিজ্ঞানের জ্ঞান তারা আয়ত্ত করলেও চেতনায় বিজ্ঞানকে ধারণ করতে পারেননি। এই অসংলগ্নতা আমাদের সমাজকে নানাভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। চ্যাপটা পৃথিবীর ধারণা থেকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে পৌঁছাতে কয়েক হাজার বছর সময় লাগে। সুতরাং তিনিই প্রকৃত মানুষ, যিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ধারা সত্যজ্ঞানে সতত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা করেন। বিজ্ঞান জন্ম দেয় সভ্যতা; সভ্যতার মধ্য থেকেই সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে। আমরা এখন যে সভ্যতার মধ্যে বাস করি, তা আসলে বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ দ্বারা সৃষ্ট একধরনের যাপিত জীবন।
বিজ্ঞান আধুনিক সংস্কৃতির অংশ হতে পারে



