আজ ৮ ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা মুক্ত দিবস

আলমডাঙ্গা অফিস
আলমডাঙ্গা—স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের নাম ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। এই দিনেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় আলমডাঙ্গা শহর। দীর্ঘ প্রতিরোধ, কৌশলগত লড়াই, ত্যাগ আর বীরত্বের মধ্য দিয়ে এই বিজয় অর্জন করেন শিকারপুর সাব-সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ চুয়াডাঙ্গা শহর মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা দুইদলে বিভক্ত হয়ে একদল ঝিনাইদহ এবং অন্যদল আলমডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের পিছু নিতে থাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধারা—রহমত উল্লাহ, আজাদুল ইসলাম আজাদ, লিয়াকত আলী, বারেক সিকদারসহ বহু বীর যোদ্ধা।
১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আলমডাঙ্গা শহর দখল করলেও পাকা ভবন হওয়ায় থানা দখল করতে পারেননি। এই বেদনা বুকের মধ্যে ধারণ করে থানা গেরিলা কমান্ডার মো. আব্দুল হান্নান পুনরায় থানা দখলের আবেদন করেন সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে। তিনি আশ্বাস দেন আমি আলমডাঙ্গায় যাচ্ছি ব্যবস্থা করো।
এরপর ৫ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে বাঁশবাড়িয়া গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেন। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা, ইউথ ক্যাম্পের শতাধিক যোদ্ধা, প্রচুর গোলাবারুদ—সব মিলিয়ে প্রস্তুতি নেয় আলমডাঙ্গা আক্রমণের। কমান্ডার কাজী কামাল, থানা গেরিলা বাহিনী এবং সাব সেক্টরের নিয়মিত সেনারা একত্র হয়ে হালশা থেকে নীলমনিগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন উপড়ে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করেন। ভোরে মাজহাদ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আসার খবর ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় ভয়াবহ দৌড়াদৌড়ি। মুক্তিযোদ্ধারাও কিছুটা বিচলিত হন। কিন্তু কান্তপুর নদীর পূর্ব পাড়ে খাদ্য হাতে এগিয়ে যেতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নেন।
নদীর পশ্চিম তীরে বটগাছতলায় গর্তে পজিশন নিয়ে গেরিলা কমান্ডার মো. আব্দুল হান্নান, শেখ নূর মোহাম্মদ জকুসহ মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক অস্ত্রের পাল্টা আক্রমণ, মর্টারের গোলা—সবই নদীর জলে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়। অল্পের জন্য রক্ষা পান মুক্তিযোদ্ধারা। এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কভারিং ফায়ারে সক্রিয় হয়ে ওঠে বাঁশবাড়িয়া ক্যাম্পও।
৮ ডিসেম্বর ভোরে পিছু হটতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা আলমডাঙ্গার পশ্চিমে কুমারী গ্রামের কাছে এন্টি-ট্যাংক মাইনে পড়লে তাদের একটি জিপ ধ্বংস হয়। এতে হানাদারদের পথ প্রদর্শক আলমডাঙ্গা বাজারের করিম নিহত হয়। কালিদাসপুর ব্রীজের কাছে আরেকটি মালবোঝাই ট্রাক বিস্ফোরণে অচল হয়ে পড়ে। মুন্সিগঞ্জ স্টেশনের দক্ষিণে রেলইঞ্জিনও বিধ্বস্ত হয়। ৮ ডিসেম্বর সকালে শত শত মানুষ থানা কাউন্সিল ভবনের সামনে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করে নেন। আলমডাঙ্গা শহর হয় সম্পূর্ণ মুক্ত।
সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে হালশার দিকে শত্রু পিছু ধাওয়া করতে এগিয়ে যান। আর ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে থাকেন। ড. তৌফিক -ই-ইলাহী চৌধুরী এই অঞ্চলের মানুষের অন্তরের চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের আগে মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তিনি দেশ স্বাধীননতা ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর যোদ্ধা শিকারপুর সাব সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে আলমডাঙ্গা অঞ্চলে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পর সরকারি সচিব, উপদেষ্টা—বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের আলোকিত নায়ক। নায়েব সুবেদার গাজী, হাবিলদার আনোয়ার আলী, নায়েক আবু তাহের, ল্যান্স নায়েক আইউব আলী, সিপাহী নাসির উদ্দিনসহ নিয়মিত বাহিনীর যোদ্ধারা; গেরিলা কমান্ডার মোবারক মাস্টার, মো. আব্দুল হান্নান, লুৎফর রহমান জোয়ার্দার, মকবুল হোসেন, আব্দুল গণি ও কাজী কামাল—সকলের অবদান আলমডাঙ্গা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অমর করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *