চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও লোকবল সংকটে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন

মুন্না রহমান, স্টাফ রিপোর্টার

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও লোকবল সংকটে চিকিৎসা সেবা মারাত্নক ব্যহত হচ্ছে। ১০০শ শয্যার এ হাসপাতালে জনবল নিয়োগ রয়েছে ৫০ শয্যার। নামে মাত্র ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি নিজেই এখন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী পরিচ্ছন্নকর্মী না থাকায় দূর্গন্ধে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে পড়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা আরো ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। জরুরী বিভাগে টাকা ছাড়া চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ১৩ লাখ জনসংখ্যা অধুষ্ঠিত বৃহৎ এ হাসপাতালে জেলার ৪ উপজেলা থেকে প্রতিদিনই ১ হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে। তবে সবার ভাগ্যে ডাক্তার মেলে না। আর অন্তর্বিভাগে বিভিন্ন ওয়ার্ডে গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে ৩০০-৩২০ জন। হাসপাতালের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেই চিকিৎসা সেবার মান। মাত্র ৯ জন মেডিকেল অফিসার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। ভোগান্তিতে রোগী ও তাদের স্বজনেরা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও চালু আছে ১০০ শয্যা। তবে জনবল আছে মাত্র ৫০ শয্যার। প্রতিনিয়তই বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ১ হাজার ২০০ রোগী। বিভিন্ন ওয়ার্ডে অন্তঃবিভাগে ভর্তি থাকে ৩০০ রোগী।

সংশ্লিষ্টরা জানায় , চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি ২০০৪ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে জনবল নেই ৫০ শয্যার। অন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগ মিলিয়ে মাত্র ২৬ জন ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। নতুন ও পুরাতন ভবন মিলিয়ে নার্স আছে মাত্র ৬৫ জন এবং পরিচ্ছন্ন কর্মী ৪ জন। অফিস সহকারী আছেন একজন এবং স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে ১৫ জন। এনেস্থেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ছিল অপারেশন থিয়েটার। গত ১০ দিন ধরে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর একজন এনেস্থিসিয়া ডাক্তার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে অতিরিক্ত সেবা দিচ্ছেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চক্ষু বিভাগে ১জন, মেডিসিন বিভাগে ১জন, এনেস্থিসিয়া ২জন, নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ১জন, রেডিওলজিস্ট ১জন, ডেন্টাল চিকিৎসক ১জন এর পদশূন্য আছে। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, আই সি ইউ এর দরজায় তালা ঝুলছে। আই সি ইউ শব্দটা যেন শুধু খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ। অ্যান্টিভেনমের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও সাপে কাটা রোগীরা অ্যান্টিভেনম না পেয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনছেন। ঔষধের তালিকায় ওমিপ্রাজল আছে বলা হলেও, মিলছে না কাঙ্খিত সেই ঔষধ। শিশু ওয়ার্ডের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই তুলনায় চিকিৎসক কিংবা নার্সের সংখ্যা একই রয়ে গেছে। মাত্র ৪ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। প্রতিটি ওয়ার্ডের ওয়াশরুম গুলোর অবস্থা শোচনীয়। বেশিরভাগ ওয়াশরুম ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

ডিঙ্গেদহ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রেজাউল করিম বলেন, হাসপাতাল প্রাঙ্গণ অপরিচ্ছন্ন। রাতে বাড়ে মশার উপদ্রব। যথাসময়ে নার্সদের ডেকেও চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় না। রোগীর হাতে ক্যানোলা পড়াতে গেলেও টাকা দিতে হয়। সব রকম ওষুধ এখানে পাওয়া যায় না, যার কারণে বাইরে থেকেও কিছু ওষুধ কিনতে হয় আমাদের।

সরোজগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন টিটু আহমেদ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে গেলেও একই রকমের ভিড়। এই হাসপাতালে তেমন কোন সেবাই পায় না আমরা। কোন গুরুতর রোগী আসলেই বাইরের অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যদি বাইরেই যাওয়া লাগে, তাহলে এই হাসপাতাল থেকে আমাদের লাভ কি?

ভালাইপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সাহার বানু বলেন, হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম। এই গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলাম। ডাক্তার যা ওষুধ লিখে দিল হাসপাতালে গিয়ে শুধু অ্যান্টাসিড ছাড়া কিছুই পেলাম না। দামি দামি ওষুধগুলো বাইরে থেকেই কিনতে হলো। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি সরকারি ওষুধ না পাই, তাহলে আমরা গরিবরা কোথায় যাব? সদর হাসপাতালে এই দৃশ্য নতুন নয়। দীর্ঘদিন যাবত চিকিৎসক ও নার্স সংকটের বিষয়টি সকলেই জানেন। এই যদি হয় চিকিৎসা সেবার মান তাহলে জেলাবাসী যাবে কোথায়?

হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর ৬ তলা ভবনের উদ্বোধন করা হয়। উদ্ধোধন হলেও জনবল সংকটের কারনে তা চালু করা যাচ্ছিল না। পরে ২০২০ সালে করনা মহামারী দেখা দিলে করনা আক্রান্ত রোগীদের নতুন ভবনে নেয়া হয়। তরপর থেকে ছয়তলা নতুন ভবনটিতে চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়। ভবনের নিচতলায় জরুরি বিভাগ ও টিকিট কাউন্টার, দ্বিতীয় তলায় বহির্বিভাগ, তৃতীয় তলায় প্যাথলজি ও ব্লাড ব্যাংক, চতুর্থ তলায় আই সি ইউ, পঞ্চম তলায় মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড এবং ষষ্ঠ তলায় পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসা সেবা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে জনবল সংকট থাকায় আই সি ইউ এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা চালু থাকলেও ২/৩ বছরেই ভবনটির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। কোথাও ভেঙে গেছে টাইলস, ভেঙ্গে পড়েছে জানালার কাঁচ। টয়লেটে বেসিন , কমোড কোনটাই আর ব্যবহার করার মত অবস্থায় নেই। ওয়ার্ডের যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা আবর্জনা। তীব্র দূর্গন্ধে জানালা খোলার মত পরিস্থিতি নেই হাসপাতালে। রোগীর সাথে স্বজনেরা হাসপাতালে আসলে এই পরিবেশের কারণে তারাও যেন রোগী হয়েই বাড়ি ফেরেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নার্সিং সুপারভাইজার রেহেনা পারভীন বলেন, পার্শ্ববর্তী জেলা মেহেরপুরে ১৬৫ জন নার্স থাকলেও, আমাদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে মাত্র ৬৫ জন নার্স কর্মরত আছেন। হাসপাতালটি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও এখানে রোগী থাকে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন। প্রতিনিয়ত এত রোগীর চাপ সামলাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। নার্সিং সুপারভাইজার মমতাজ বেগম বলেন, সদর হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ড ২২ শয্যা বিশিষ্ট, কিন্তু রোগী আছে প্রায় ৮০ জন। এই ওয়ার্ডে খাবার বরাদ্দ আছে ২২ জনের। কিন্তু চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা সকলেই খাবার চায়। এই নিয়ে নানারকম অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। তিনি আরো বলেন,  হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা নিয়মিত ডাস্টবিন ব্যবহার করে না। এতে করে এখানকার পরিবেশ দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে মাত্র ৪ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী আছে। এই স্বল্প সংখ্যক পরিচ্ছন্ন কর্মী দ্বারা হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখা একটু কষ্টকর। জনবল সংকট দূর হয়ে গেলেই এখানকার  পরিবেশ ভালো হবে বলে আমি মনে করি।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মোঃ আব্দুস ছবুর বলেন, বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগ মিলিয়ে মোট ২২ জন চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। আমি যতটুকু জানি, হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট করার জন্য প্রস্তাবনা করা হয়েছে। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট করার জন্য মোট ৬৫ জন মেডিকেল অফিসার দরকার। আশ পাশের সব জেলা হাসপাতালগুলো ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি আজও ১০০ শয্যায় রয়ে গেছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও চালু আছে বর্তমানে ১০০ শয্যা। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হলে রোগীদের চিকিৎসা নিতে আর কোন সমস্যা হবে না। হাসপাতালের আইসিইউ অকেজো অবস্থায় আছে। কবে নাগাদ চালু হবে তা সঠিক বলতে পারছি না। আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি চুয়াডাঙ্গাসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে সাপে কাটা রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম ও সরবরাহ আছে। হাসপাতালে ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।  তিনি আরো বলেন, মাঝে মাঝে আমরা দেখতে পাই দালাল চক্রের কিছু লোকজন হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করছে। তারা রোগী ও তাদের স্বজনকে ভুল বুঝিয়ে প্রতারণা করে নানান ভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। হাসপাতাল দালাল চক্রের কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না।

                  চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আওলিয়ার রহমান বলেন, ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে বৃহত এ হাসপাতালের কার্যক্রম। আমরা ১০০ শয্যার জনবল চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। খুব দ্রুতই আমরা জনবল পেয়ে যাবো। ডাক্তারসহ অন্য জনবল পেলে বর্তমানে যে সমস্য রোগীরা পোহাচ্ছে তা দুর হয়ে যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *