জাতীয় নারী ক্রিকেট দলে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দুজন সদস্য যুক্ত করার আহ্বান: টিআইবি

আজকের চুয়াডাঙ্গা ডেস্ক

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজারের বিরুদ্ধে একজন সুপরিচিত নারী ক্রিকেটারের যৌন হয়রানির অভিযোগের তদন্ত কমিটি গঠনই যথেষ্ঠ নয়, এই কমিটির কার্যক্রমে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের স্বার্থে কমিটিতে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অন্তত দুজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নির্দেশিকা অনুযায়ী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) যৌন হয়রানি প্রতিরোধসহ সেইফগার্ডিং (সুরক্ষা) নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন কমিটি না থাকায় গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছে টিআইবি। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পুরুষের তুলনায় উজ্জ্বলতর সাফল্য বয়ে এনেছেন, এ সাফল্য অবমূল্যায়নের এর চেয়ে ধিক্কারজনক দৃষ্টান্ত আর থাকতে পারে না বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। রবিবার টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নারী দলের ম্যানেজার ও নির্বাচকসহ আরো বেশ কয়েকজন বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের একজন সুখ্যাতিসম্পন্ন ক্রিকেটার এবং এ অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে বিসিবি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। তবে এ কমিটির কার্যক্রমে পরিপূর্ণ পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও কার্যকরতা নিশ্চিতের স্বার্থে যৌন হয়রানির মতো বিশেষ ক্ষেত্রে অভিযোগ তদন্তের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সম্পন্ন  অন্তত দুজন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞকে তদন্ত কমিটিতে যুক্ত করতে হবে। এখানে আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, এর আগেও উত্থাপিত যৌন নীপিড়নের অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বিসিবি, বরং অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে নীপিড়কের বিচারহীনতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। যা বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট তথা সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনে একদিকে যেমন পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করছে, অন্যদিকে নারীর অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে পদদলিত করার ষড়যন্ত্রের অংশ কি-নাÑএ প্রশ্ন উত্থাপন করা মোটেও অযৌক্তিক নয়। ’

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘উত্থাপিত অভিযোগকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই, বরং উক্ত ক্রিকেটার এ অভিযোগ সামনে আনার পর আরো অনেক অভিযোগের কথাই জানা যাচ্ছে। এ সকল অভিযোগের কোনো রকম প্রতিকার না হওয়া প্রমাণ করে, বিসিবিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও আইসিসির নির্দেশিকা অমান্য করে যৌন হয়রানি রোধে নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অনুপস্থিত থাকাই শুধু সমস্যা নয়, বরং নারী ক্রিকেটারদের জন্য সমঅধিকারমূলক ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির পথে প্রতিকূলতাকে রীতিমতো স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়েছে। অনতিবিলম্বে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীন যৌন হয়রানির অভিযোগ গ্রহণ ও প্রতিকার কমিটি গঠন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিসিবিকে যৌন হয়রানি প্রতিরোধসহ নিজস্ব সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কাঠামো গঠনের আহ্বান জানাই আমরা।’

২০০৯ সালের ১৫ মে তারিখের উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়, যা বিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান কোনো ক্রমেই অমান্য করতে পারে না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নীতিমালারও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে চলেছে বিসিবি। আইসিসির ঝধভবমঁধৎফরহম এঁরফধহপব ভড়ৎ গবসনবৎং (মে ২০১৯) অনুযায়ী, প্রতিটি সদস্য বোর্ডের দায়িত্ব নিজ নিজ পর্যায়ে সকল অংশগ্রহণকারীর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, প্রত্যেক বোর্ডকে এমন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে যৌন হয়রানি, বৈষম্য বা ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকে।

নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি বোর্ডে প্রশিক্ষিত একজন ঝধভবমঁধৎফরহম ঙভভরপবৎ বা ঋড়পধষ চড়রহঃ থাকতে হবে, যিনি অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা কাঠামো বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবেন। আইসিসির নীতিমালা অনুযায়ী, যৌন হয়রানি, মানসিক নির্যাতন বা ক্ষমতার অপব্যবহার কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না, এবং সদস্য বোর্ডগুলোকে তবৎড় ঃড়ষবৎধহপব নীতি অনুসরণ করে নেতৃত্ব পর্যায়ে দৃশ্যমান দায়বদ্ধতা দেখাতে হবে। দ্রুততম সময়ে বিসিবিকে আইসিসি-এর নির্দেশনা অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র, জেন্ডার সংবেদনশীল ও কার্যকর ঝধভবমঁধৎফরহম চড়ষরপু প্রণয়ন, প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা নিয়োগ এবং ভবিষ্যতের সব তদন্তে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ম্যাচ ফিক্সিং, আর্থিক অস্বচ্ছতাসহ বিসিবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বারবার সামনে আসছে, যা বিসিবির সামগ্রিক সুশাসনে ব্যর্থতা, নৈতিক দুর্বলতা, জবাবদিহি ও আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করছে। এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এর প্রায় প্রতিটি মৌসুমেই ফিক্সিংয়ের অভিযোগ এবং আজ পর্যন্ত এ সংকট বিসিবি কখনোই সমাধান করতে পারেনি।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেটে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সুশাসন নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট স্বাধীন ও পেশাদার দুর্নীতি দমন ইউনিট গঠন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, তদন্ত ও দণ্ডমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বতন্ত্র, আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন স্থায়ী ন্যায়পাল কার্যালয় স্থাপন, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা সুসংহত করা, ক্রিকেটের সকল স্তরে নীতি, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রচারসহ বিসিবি ও তৎকালীন সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিলো টিআইবি। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। বর্তমান ক্রিকেট বোর্ডও একই পথ অনুসরণ করছে, যা হতাশাজনক ও ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য আত্মঘাতী বলে মনে করে টিআইবি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *