ফিরে দেখা ৪ আগষ্ট/২০২৪ চুয়াডাঙ্গার চিত্র সরকার পতনের এক দফা দাবিতে চুয়াডাঙ্গায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন জমাট বেধে ওঠে

স্টাফ রিপোর্টার

৩ আগষ্ট শনিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীরা এক দফা দাবিতে সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলন কর্মসুচি পালনের ডাক দেন। এতে চুয়াডাঙ্গার পরিবেশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সারাদেশের ন্যায় চুয়াডাঙ্গাতে রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ জারি করা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। ৪ আগষ্ট দিনব্যাপী চুয়াডাঙ্গা শহর ছিলো উত্তেজনাপূর্ণ। চারিদিকে মানুষের মনে এক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছিলো। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে জেলা সদর ছাড়াও উপজেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারন মানুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। ফলে আন্দোলন জমাট বেধে ওঠে। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে না গেলে বাধার মুখে পড়েন তারা। রোববার সকাল থেকে জেলাজুড়ে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। বেলা ১১টা থেকে চুয়াডাঙ্গা- মেহেরপুর সড়কের ভালাইপুর বাজারে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। একই সাথে শহরের কোর্ট মোড়ে এলাকাতেও বিক্ষোভ করতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে পড়েন আন্দোলনকারীরা। দর্শনা শহরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হলে তাদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। এছাড়াও জেলার বদরগঞ্জ, জীবননগর ও আলমাডাঙ্গায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে জেলাজুড়ে এক অজানা আতংক বিরাজ করতে থাকে । 

                একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঘোষনা অনুযায়ী রোববার বেলা ১১ টার দিকে শহরের কোট মোড়ে শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হতে থাকেন। এ সময় তাদের প্রতিরোধ করতে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও সেখানে আলাদা আলাদাভাবে আসতে থাকে। জেলা যুবলীগের কয়েকজন সদস্য সেখানে আসা শিক্ষার্থীদের জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। আবার কাউকে কাউকে ইজিবাইকে তুলে দিয়ে স্থান ত্যাগ করতে বলা হয়। তারপরও শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে আসতে থাকেন।

কোর্ট মোড়ে দাঁড়াতে না পেরে শিক্ষার্থীদের আইনজীবী ভবন চত্বর ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরের দিকে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়াতে দেখা যায়। জেলা ছাত্রলীগের কর্মীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের গেটে অবস্থান নেন। তারা সেখানে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি ব্যানার কেড়ে নিয়ে ছিড়ে ফেলেন। তারা কোর্ট মোড় এলাকা তথা পুরো কোর্ট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বের করে দেন। কিছু শিক্ষার্থী বিচ্ছিন্নভাবে সরে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পরেই কাঠপট্টি এলাকা থেকে কিছু শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল বের করার চেষ্টা করেন। এ অবস্থায় তারা মিছিল নিয়ে হাসপাতাল রোড এলাকায় যান। সেখানে সনো টাওয়ারের পাশের গলিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মিরা মিছিলে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এ সময় যুবলীগের নেতা কর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতাল রোডসহ শহরের বিভিন্ন অলি গলিতে মহড়া দেয়। এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের বড় বাজার, শহীদ আবুল কাশেম সড়ক, কোর্ট রোড, পুরাতন হাসপাতাল রোডের বেশির ভাগ দোকানপাট দুপুরের দিকে বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। বিকেলের দিকে অল্প কিছু দোকানপাট খোলা হয়। সারাদিনে চুয়াডাঙ্গা থেকে কোনো বাস ছাড়েনি। ফলে ইজিবাইক, লেগুনা ও পাখিভ্যানযোগে সাধারণ মানুষ চলাচল করে।

৪ আগষ্ট রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ শুরু হলে চুয়াডাঙ্গা শহরে কমতে থাকে সাধারণ মানুষের চলাচল। দিনব্যাপী আন্দোলন-উত্তেজনায় থাকা চুয়াডাঙ্গা শহর সন্ধ্যার পরই ফাঁকা হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিতে থাকেন। শহরে অতিরিক্ত পুলিশের অবস্থান দেখা যায়।

এদিকে রোববার সকাল সাড়ে ১০ টায় চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুর বাজারে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এক দফা দাবি আদায়ে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় তারা। সৃষ্টি হয় যানজটের। এ সময় এক দফা দাবি পূরন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষনা দেয়া হয়। তারা বলেন কেউ বাধা দিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।

অপরদিকে শিল্পনগরী দর্শনাতে শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠে। এদিন বেলা ১১ টার দিকে দর্শনা প্রেসক্লাবের সামনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করে। মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে মিছিলটি দর্শনা বাসষ্ট্যান্ড চৌরাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয়।  অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে সাধারন শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মিরা হামলা ও বোমার বিস্ফোরন ঘটায়। এতে অম্লান (১৮), নাহিদসহ (১৯) ৩ জন জখম হয়।

অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন প্রতিহত করতে দিনব্যাপি সরব ছিল আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠনসমুহের নেতা কর্মিরা। রোববার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক ঘুরে বড় বাজার গিয়ে প্রতিবাদ সভা করে। সভায় বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ন সাধারন সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম টোটন, এ্যাড. শামসুজ্জোহা, মুন্সি আলমগীর হান্নান প্রমুখ। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আয়োজনে অবস্থান কর্মসুচী পালন করা হয়। তারা কেদারগঞ্জ বাজার থেকে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা সহকারে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় শহরের কোর্ট মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহবায়ক ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু। তিনি বলেন শিক্ষার্থীদের সব দাবি শেখ হাসিনা মেনে নিয়েছেন। তাহলে কেন আন্দোলন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক সদস্য সচিব ও কর্মসূচির অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক সাফফাতুল ইসলাম বলেন, ৪ ই আগস্ট চুয়াডাঙ্গাতে বিভিন্ন স্থানে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগঠিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চুয়াডাঙ্গা সদর, জীবননগর উপজেলা এবং আলমডাংগা উপজেলা। ভালাইপুরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে পুলিশ এবং আওয়ামীলীগের সমর্থকেরা পিছু হাটতে বাধ্য হয়। চুয়াডাঙ্গার মতো সীমান্তবর্তী জেলায় আমরা যে সক্ষমতা দেখিয়েছি, তা শুধু স্থানীয় নয়, কেন্দ্রীয় আন্দোলনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমরা মনে করি আমাদের অংশগ্রহণ জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতিকে নতুন দিশা দিয়েছেন। আমাদের নেতৃত্ব ভবিষ্যতের আন্দোলনকেও অনুপ্রাণিত করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *