বিজ্ঞান ও সংঘ সমার্থক শব্দ নয়। বিজ্ঞানের সাথে ‘সংঘ’ শব্দটি আমাদের দেশে দ্ব্যর্থমূলক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেখানে আনন্দ ও উচ্ছলতা আছে, সেখানে সংঘের প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান থাকে। সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা অবসর সময়ে নাটক, সংগীতচর্চা এবং খেলাধুলা করতে পারি। এই জন্য আমরা সংঘ বা বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলি। কিন্তু বিজ্ঞান তো একটি নীরস, দুর্বোধ্য কাজ বলে মনে হয়। বিজ্ঞান কাজ করে মনহীন প্রকৃতিকে নিয়ে, তাও আবার অপরিচিত ভাষায়। বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের মনে উদ্ভাসিত হয় পদার্থবিদ্যার জটিল সূত্রগুলোর দুর্বোধ্যতা এবং গণিতের জটিলতা। আমাদের দেশে কোনো বিজ্ঞান সংঘ নেই। প্রকৃতিকে জানার জন্য আমাদের দেশে এই জাতীয় সংঘ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
বিজ্ঞান তার দীর্ঘদিনের সাধনায় বিভিন্ন শাখায় বিকশিত হয়েছে। বিচিত্রভাবে গড়ে উঠেছে তার সংজ্ঞা। বিজ্ঞানকে আমরা জানি সুশৃঙ্খল ও সুষমভাবে রূপবদ্ধ নির্ভুল সত্য হিসেবে। বিজ্ঞানের সত্যগুলো আমাদের অভিজ্ঞতার নির্যাস। বিজ্ঞানীরাও আমাদের মতো সমাজবদ্ধ মানুষ। তাঁদের ভীষণ পরিশ্রম করে গণিতের সূত্র উদ্ভাবন করে বিজ্ঞান সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মূলে যে জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া কাজ করে, তার বিশ্লেষণ অতি জটিল।
একজন ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীর প্রস্তুতির আগে তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হয় অনুসন্ধিৎসু ও পর্যবেক্ষণের আবহে। কিন্তু আমাদের সমাজে নির্মোহ বিজ্ঞানচর্চার কোনো পরিবেশ নেই। আমাদের সমাজে এখন নানা ধরনের মানুষের দেখা মেলে। তাঁরা বিভিন্ন বক্তৃতা, সেমিনার এবং আলোচনায় বিজ্ঞানের নিয়ম ও কাজকে মানুষের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। ফলে সাধারণ মানুষের মনে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের নিয়মগুলো ভুল ব্যাখ্যা দেয়।
এ কথা সত্য যে আধুনিক বিজ্ঞান এত অগ্রসর ও ব্যাপক এর পরিণত রূপ এত শৃঙ্খলাবদ্ধ যে নিয়মতান্ত্রিক পাঠক্রম বা পদ্ধতি অনুসরণ না করলে বিজ্ঞানের শিক্ষায় সমৃদ্ধ হওয়া যায় না। শত শত বছর ধরে হাজার হাজার বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত জ্ঞানের ফলাফলের সাথে মাত্র কয়েক বছরে পরিচিত হওয়ার সংক্ষিপ্ত ও সহজ পথ বিদ্যালয় ও তার বিধিবদ্ধ পাঠ্যসূচি দিয়ে সবটা প্রকাশ করা যায় না। বই ও বিদ্যালয় হলো বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতাকে পৌঁছে দেওয়ার একমাত্র পথ। তাই বিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা ও শিক্ষকের মানহীনতা বিজ্ঞানকে মানুষের চেতনা বিকাশের কাজে ব্যবহার করা দুরূহ বিষয় হয়ে ওঠে। নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনাকে ভরসা করে অসম্ভবের আকাংক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রকৃতির বিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে যে ফল লাভ করা যায় তা আমাদের সকলের সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। এখানেই রয়েছে বিজ্ঞানের দর্শনকে আপন করে নেওয়ার প্রাসঙ্গিকতা। আমেরিকা, ইউরোপ ও রুশদেশে বিজ্ঞান সংঘ বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞানী সৃষ্টি ও বিজ্ঞানের প্রতিভা বিকাশ ও বাছাইয়ের কাজে বিরাট ভূমিকা রাখে।
আমরা যদি ওরকম কোনো বিজ্ঞান সংঘ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে তাদের প্রধান কাজ হবে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র এবং বিজ্ঞানে উৎসাহী অ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহ সৃষ্টি করা। কিশোর বয়সে সৃষ্টি করার, উদ্ভাবন করার, বিশ্বকে জানার যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা জাগে, তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান সংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবেই জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব। আমাদের সমাজের সীমাহীন অজ্ঞতাকে দূর করতে হলে সকলকেই বিজ্ঞানের জ্ঞানকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে হবে।
লেখক- জাহিদ হোসেন



