ফিরে দেখা জুলাই ৩৬/২০২৪ চুয়াডাঙ্গায় পুলিশের গ্রেফতার ও ফ্যাসিষ্ট  আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর কারনে কোটা আন্দোলন কঠিন হয়ে পড়ে

স্টাফ রিপোর্টার

কোটা আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীরাও কোটা সংস্কার আন্দোলনে শরীক হয়েছেন। প্রথম অবস্হায় জীবনের ঝুকি নিয়ে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী এ আন্দোলন শুরু করেন। ঢাকায় আন্দোলন যত বেগবান হয়, ততই সাধারন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহন চুয়াডাঙ্গাতে বেড়ে যায়। তবে, পুলিশ প্রশাসনের ব্যাপক নজরদারি ও ধর পাকড়ের কারনে কোটা আন্দোলন বেগবান করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এর বাইরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতারা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অথবা মোবাইলে হুমকি দিয়ে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে। এতে শহর সহ গ্রামের মানুষের মধ্যে একটি ভীতি তৈরী হয়। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সাদা পোশাকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানান প্রশ্নবানে জর্জরিত করে রাখত। ২০২৪ সালে জুলাই মাস থেকে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত টানা ৩৬ দিন চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪ উপজেলার মানুষের মধ্যে এক অজানা আতংক বিরাজ করতো। অনেকেই কোটা বিরোধী আন্দোলন ও সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনকে সমর্থন দিলেও প্রকাশ্যে রাস্তায় নামতে ভয় পেত। মূলত চুয়াডাঙ্গাতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সুচনা হয় ৬ জুলাই। এরপর ১১ জুলাই, ১৪ জুলাই, ১৮ জুলাই ও ৪ আগষ্ট। এরমধ্যে ১৮ জুলাই চুয়াডাঙ্গা শহর ও সরোজগঞ্জ বাজারে বড় ধরনের শোডাউন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও সাধারন ছাত্ররা। সেই সময়  ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র ও  দেশীয় অস্ত্রের হামলায় ১০/১২ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। আর সর্বশেষ আন্দোলন জমে ওঠে ৪ আগষ্ট। সেদিন চুয়াডাঙ্গা শহর, জীবননগর, আলমডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ, সরোজগঞ্জে মিছিল ও অবস্থান কর্মসুচী পালন করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব রনি বিশ্বাস বলেন, গত বছরের জুলাইয়ের সেই ৩৬ দিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা ভূলবার নয়। সব সময় এক অতংকের মধ্যে দিয়ে পার করতে হতো। তারপরেও মনে হতো দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে। সেই ধারনা থেকে শত বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে গেছি। প্রথম কর্মসুচী পালন করার সিদ্ধান্ত নিই ৬ জুলাই। সেদিন আমি ও অর্ক ভাই মুঠোফোনে মানববন্ধন বাস্তবায়নে পরিকল্পনা করি। ৬ জুলাই বেলা ১১ টায় চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে আমরা মাত্র ৭ জন ব্যানার নিয়ে দাড়িয়ে পড়ি। আমার নেতৃত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলো ইমরান, আসিফ আরাফাত, তাজওয়ার, আহিন, তাহমিদ ও সুজন। মানববন্ধন শেষে বাড়ি পৌছানোর আগেই গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের লোকজন বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। এরপর মানববন্ধনের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে আমরা ৭ জন গোয়েন্দা নজরদারিতে পড়ে যায়। আমরা ১১ জুলাই পুনরায় চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের ডাক দিই। ওই দিন আমরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হই। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আমাদের মানববন্ধনে বাধা দেয়। এমনকি গ্রেফতারের হুমকি দেখাই। আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিলাম। বাধ্য হয়ে যে যার মত এলাকা ত্যাগ করি। তবে আমরা পুলিশকে বলেছিলাম হাইকোর্টের আদেশের কারনে আমরা মানববন্ধন করছিনা। তবে আমাদের দাবি পুরন না হলে আমরা পরবর্তীতে বিক্ষোভ মিছিল করব। 

১৪ জুলাই আমরা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের সিন্ধান্ত নিই। এবারের নেতৃত্বের পরিবর্তন করা হয়। সজিবুল ইসলামের নেতৃত্বে ডিসি অফিসে স্বারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৬ জুলাই সকাল ১০টায়  আবারো চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের সিদ্ধান্ত নিই। সেই মোতাবেক আমি ও তামান্না সকাল ৯টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে চলে আসি। জানতে পারলাম পুলিশ আজকেও আমাদের কর্মসুচী পালন করতে দেবে না। আমরা সিদ্ধান্তে অটল, যে কোন ভাবে আমরা ব্যানার ধরে মানববন্ধন করব। সেই কারনে আমরা মোবাইলে সবাইকে জানিয়ে দিলাম সাড়ে ৯টায় আমরা কর্মসুচী পালন করব। সেই মোতাবেক পৌনে ১০টার মধ্যে আমরা অনুষ্ঠান শেষ করে এলাকা ত্যাগ করি। এদিন আমাদের ৭০/৮০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলো। তখন অনুষ্ঠানের ব্যানার প্রিন্ট করা খুব রিস্ক ছিলো। হ্যান্ড মাইক কেউ নিতে চাইতো না।

১৮ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের জন্য আমরা ১৭ জুলাই মিটিং করি। আমি তামান্না, আসলাম হোসেন  অর্ক, শাওন, সাফফাতুলসহ কয়েকজন প্লান রেডি করি। আমাদের সিদ্ধান্ত হয় সরকারী কলেজের সামনে অবস্থান কর্মসুচী পালন করব। তবে যোগাযোগ করতে না পারায় আমরা কেউ কেউ সরকারী কলেজের সামনে আবার কেউ কাঠ পট্টির মধ্যে অবস্থান নিই। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারনে ছাত্রলীগ আমাদের ছেলে-মেয়েদের উপর হামলা চালিয়ে আহত করে। এর মধ্যে ইমমদাদুল হক শাওনসহ ৫ জন গুরুতর আহত হয়। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আলমডাঙ্গা উপজেলা শাখার সাবেক সদস্য সচিব আরাফাত বলেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আক্রমনের কারনে আমরা মাঠে নামতে পারি নাই। তবে ৩১ জুলাই আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ মদনবাবুর মোড়ে মার্চ ফর জাষ্টিস কর্মসুচী পালন করি। বেলা ১২ টার দিকে আমরা ১৭/১৮ জন ১০ মিনিট অবস্থান কর্মসুচী পালন করতে পেরেছিলাম। এরপর পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে আমরা ৩ জন আহত হয়। সর্বশেষ ৪ আগষ্ট বেলা ১১ টায় আলমডাঙ্গা স্টেডিয়াম মাঠে এক দফার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিই। কিন্তু ছাত্রলীগের গুন্ডা বাহিনী আমাদেরকে মাঠে ঢুকতে দেয়নি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাদের ১৫/১৬ জন শিক্ষার্থীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধা প্রদান করে। আমরা নিরুপায় হয়ে পরে পালিয়ে অন্য হাসপাতালে চলে যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা সদর শাখার সাবেক যুগ্ম আহবায়ক রিমন মন্ডল, তামিম হোসেন ও সদস্য সাব্বির হুসাইন বলেন, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় আন্দোলন দানা বেধে উঠে সরোজগঞ্জ বাজারে। আমরা ছাত্র সমাজ আওয়ামীলীগের মারমুখী ভূমিকার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। ১৮ জুলাই সকাল ১০টায়  আমরা সরোজগঞ্জ বাজারে অবস্থান কর্মসুচী পালন করার জন্য জড়ো হয়। এ সময় আমরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে এগিয়ে যায়। ৩০ মিনিট প্রধান সড়ক ব্লকেড করে রাখি। আওয়ামীলীগের গুন্ডা বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমন করে। আমরা আশেপাশের দোকানে সেল্টার নিই। এতে আপন, দিগন্ত ও ফিমা নামে ৩ জন জখম হয়। ৪ আগষ্ট আন্দোলনে আরো গতি পাই। এক দফার সমর্থনে আমাদের সাথে যোগ দেয় জামায়াত ও বিএনপি। শিক্ষার্থীরা সরোজগঞ্জ বাজারে “পুলিশ তুমি পোশাক ছাড়ো, মুজিব কোট গায়ে পড়ো, পুলিশ তুমি ভূয়া, প্রশাসন ভূয়া শ্লোগানে” মুখরিত করে রাখা  হয়। অনুষ্ঠান শেষে গ্রেফতার আতংকে আমরা রাতে বাড়িতে থাকতে পানি নাই। এদিকে ১৭ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে জীবননগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে সমাবেশ করে। পরে এক দফার দাবিতে ৪ আগষ্ট জীবননগরে শান্তিপূর্ণ মিছিল সমাবেশ করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক যুগ্ম আহবায়ক সিরাজুম মুনিরা বলেন, আমাদের কষ্ট লাগে, আমাদেরকে যারা লাঠিপেটা করে আবার আমাদের সামনে তারা ঘুরে বেড়াই। ৪ আগষ্ট আমি, খুশবু, অনিমাসহ ২০ জন মেয়ে ও ৮/১০ জন ছেলে চুয়াডাঙ্গা শহরের কোর্ট মোড়ে জড়ো হয়। ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাদের ব্যানার কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমরা ভয়ে আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে আশ্রয় নিতে চাইলে, আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করে আমরা আবার হাসপাতাল রোডে জড়ো হয়। এবার সেখানে ছাত্রলীগে ছেলেরা লোহার রড দিয়ে মেরে আমাদের ৪ জনকে গুরুতর আহত করে। আমরা হাসপাতালে গেলে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়নি। এরপর বাড়ি এসে দেখি ছাত্রলীগের গুন্ডারা আমার বাড়িসহ আরো ২টি বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর করেছে। প্রশাসনের কাছে বিচার চেয়েও আমি এখনও বিচার পাইনি। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক আহবায়ক আসলাম হোসেন অর্ক বলেন, আমি ঢাকাতে থেকে চুয়াডাঙ্গার আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি। তারপরেও যে যেরকম পেরেছে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। আন্দোলনের কৌশল হিসাবে, আজকের কর্মসুচীতে যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পরবর্তী কর্মসুচীতে অন্য কাউকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়েছে। যাতে পুলিশ সনাক্ত করতে না পারে।  ঢাকার আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গার ২ জন শহীদ হয়েছেন। এরা হলেন মাসুদ রানা মুকুল (৩৫) ও শাহরিয়ার শুভ (২৮)। এছাড়াও  বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চুয়াডাঙ্গায় ৪৬ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় আন্দোলন করতে গিয়ে আহত হয়েছেন ১৮ জন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *