গত বছরের তুলনায় এবার ৪ গুণ বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে বর্ষায় ব্যস্ততা বেড়েছে মাছ ধরার উপাদান বিত্তি তৈরির কারিগরদের

হাসান নিলয়, জীবননগর

গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আষাঢ় মাসের শুরু হওয়ার আগে থেকে প্রতিদিন কখনো হালকা, মাঝারি আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪ উপজেলার বিল, বাওড়, পুকুর, ডোবা ও জলাশয়। বৃষ্টির নতুন পানিতে উঠে আসছে দেশি প্রজাতির মাছ। দেশীয় ছোট মাছ ধরতে সেই কারনে চাহিদা বেড়েছে বিত্তির। এই ছোট মাছ ধরার উপকরণ বিত্তি বা ঘুর্ণি তৈরির কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের শৈলমারী গ্রামবাসির।

সরজমিনে শৈলমারী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির নারী ও পুরুষেরা বিত্তি তৈরির কাজে এখন অনেক ব্যস্ত সময় পার করছে। এই গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরার বিত্তি তৈরির কাজ করেন। বিত্তি তৈরির কাজ করে পরিবারগুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এবার বর্ষায় বৃষ্টিপাত বেশি তাই বিত্তির চাহিদা বেশি। সবাই পাল্লা দিয়ে বিত্তি বুননের কাজ করে যাচ্ছে। মাছ ধরার বিত্তি তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ, তাল গাছের ডগার সুতা ও নাইলনের সুতা। তাল গাছের ডগাগুলো পানিতে ভিজিয়ে রেখে পঁচিয়ে নিতে হয়। তারপর আঁশ থেকে সুতা হয়। বাঁশ সাইজ মত কেটে তা দিয়ে কাঁটি তৈরি করতে হয়। বাঁশের কাঁটি, তালের সুতা ও নাইলনের সুতা দিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ নিপুণ হাতে বিত্তি তৈরি করেন। এবার বর্ষায় খাল-বিল, নদী, ডোবা, পুকুর, মাঠ পানিতে থৈথৈ করছে। এ সময় জেলে ও স্থানীয়রা বিত্তি পেতে কাটরা, পুঁটি, চিংড়ি, টাকি, ঝাঁয়া, বাইনসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরেছে। বিশেষ করে ছোট মাছ ধরায় এর তুলনা হয়না।  প্রতিটি বিত্তি প্রকারভেদে বাজারে বিক্রি হয় ৩০০-৬০০ টাকা দরে। বাজারে এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। কারণ এখানকার তৈরি বিত্তির মান ভাল।

বিত্তি তৈরির কারিগর মন্টু মিয়া বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত বেশি। যার কারনে বিত্তির চাহিদাও বেশি। এখন অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি। আমরা খুচরা ও পাইকারি দামে বৃত্তি বিক্রি করে থাকি। তিনি আরও বলেন, একটি মাঝারি সাইজের বাঁশ ২০০ টাকা থেকে আড়াইশো টাকায় কিনতে হয়। তাল গাছের ডগা ৩০ টাকায় কিনতে হয়। এর সাথে লাগে লাইলন সুতা। এসব দিয়ে তৈরী করা বৃত্তি। একটি বাশ দিয়ে ৩/৪টি বৃত্তি তৈরী করা যায়।  এ কাজে অনেক বেশি পরিশ্রম। আমাদের গ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার বিত্তি বিক্রি হয়। জেলার শিয়ালমারি হাটে গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন ব্যাপারিরা মাছ ধরার বিত্তি নিয়ে এসেছে। অনেকে কেনার জন্য দরদাম করছে।

বিত্তি তৈরির কারিগর মর্জিনা খাতুন বলেন, বিয়ের পর আমার শাশুড়ীর কাছ থেকে আমি এই কাজ শিখি। পুরুষদের পাশাপাশি আমরাও বিত্তি তৈরির কাজ করি। এতে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে। সপ্তাহে ৩-৪টি বিত্তি তৈরি করতে পারি। এবার বিত্তির চাহিদা বেশি। বিত্তি তৈরি করতে গিয়ে রান্নার সময় পাচ্ছি না। আরেক বিত্তি তৈরির কারিগর তানভীর রহমান বলেন, গত বছরের এই সময় বিত্তি কেনার খরিদ্দার ছিলো না। কিন্তু এই বছরে বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারনে বিত্তির অনেক চাহিদা বেড়ে গেছে। বিত্তির অর্ডার পেয়ে আমরা এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই কাজই করে যাচ্ছি। গ্রামবাসীরা বলেন, শুধুমাত্র বর্ষাকালে এই কাজ বেশি হয়। বছরের বাকি সময় আমাদের বসে থাকতে হয়। এবার বৃষ্টিপাত বেশি তাই আমাদের কাজকর্ম বেশি। কিন্তু প্রতিবছরই এমন বর্ষা হয় না। সরকারি অথবা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমাদেরকে বিত্তি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হাতুড়ি, করাত, সুতালি ইত্যাদি বিতরণ করলে আমাদের একটু সুবিধা হয়। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তার দাবি করেন তারা।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবার অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারনে খাল, বিল ও ডোবাই মাছ হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট মাছ ধরতে প্রয়োজন হয় বৃত্তির। স্থানীয়ভাবে এটা তৈরী হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গায় বর্তমানে বৃত্তির চাহিদা বেড়েছে। বৃষ্টির কারনে বৃত্তি তৈরীর কারিগরদের চাহিদা বেড়েছে। বৃষ্টির সাথে এ শিল্পটা জড়িত।  তিনি আরো বলেন, উপজেলা অফিসে যোগাযোগ করলে বৃত্তি তৈরীর যে উপকরণ লাগে সেটা সরবরাহ করার চেষ্টা করা হবে। 

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চুয়াডাঙ্গায় ৯৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। এবার ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ৪১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *