চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী আকাশ হত্যার বিচারের দাবিতেউথলী রেলস্টেশনে কপোতাক্ষ ট্রেন থামিয়ে স্থানীয়দের মানববন্ধন দ্রুত বিচার না হলে কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারী টিটিইসহ ৫ জনকে আসামী করে হত্যা মামলা

উথলী প্রতিনিধি
চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী আলোচিত আকাশ হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে স্থানীয়রা। মানববন্ধনে উথলী ইউনিয়নের সকল শ্রেণী পেশার মানুষজন ও নিহত আকাশের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আব্দুল গাফ্ফার আকাশ(২৬) সেনেরহুদা গ্রামের জিন্নাত আলীর একমাত্র ছেলে। মানববন্ধন চলাকালীন সময়ে খুলনা হতে রাজশাহীগামী আন্তঃনগর কপোতাক্ষ ট্রেন সকাল ৯ টা ২০ মিনিটের সময় উথলী রেলস্টেশনে পৌঁছালে বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রেনটি আটকিয়ে রাখেন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ এবং এলাকাবাসীর সহযোগীতায় ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর ট্রেনটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
এলাকাবাসী জানায়, রবিবার সকাল সাড়ে ৮ টা থেকে সেনেরহুদা গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় লোকজন মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। আকাশ হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায় তারা। দাবি পূরণ না হলে পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারি দেয়া হয় মানববন্ধন থেকে। সকাল ৯ টা ২০ মিনিটের দিকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী আন্তঃনগর কপোতাক্ষ ট্রেন থামিয়ে ট্রেনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে তারা।
উথলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও নাগরিক সংগঠন জীবননগর উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে মানববন্ধন কর্মসূচিটি হয়। বক্তব্য রাখেন সেনেরহুদা জান্নাতুল খাদরা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মহিউদ্দিন ও জেলা জামায়াতের শুরা সদস্য মাওলানা মো. মহিউদ্দিন, স্থানীয় বিএনপি নেতা ফয়সাল মাহাতাব, নিহত ব্যক্তির বাবা জিন্নাত আলী, মা তহমিনা খাতুন বিউটি ও স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার।
বক্তব্যে তারা বলেন, আকাশকে পরিকল্পিতভাবে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। দ্রুত তদন্ত করে বিচার না করলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারী দেন তারা। এ সময় কপোতাক্ষ ট্রেনের দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমানের হাতে একটি লিখিত অভিযোগ তুলে দেন তারা। মানববন্ধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিহত আকাশের শোকার্ত পিতামাতা। এছাড়াও মানববন্ধন অনুষ্ঠানে নিহত আকাশের ৯ মাস বয়সের পুত্র সান্তান সাথে নিয়ে সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তার স্ত্রী।


উল্লেখ, গত ২১ মে কপোতাক্ষ ট্রেনযোগে চুয়াডাঙ্গা থেকে বাড়ি ফেরার পথে জয়রামপুর আখ সেন্টারের নিকট রেল লাইনের পাশে পড়ে ছিলো গাফফার আলী আকাশ (২৬) নামে এক যুবকের মরদেহ। এলাকাবাসীর ধারনা করে বলেছিল ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। সে চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাৎক্ষনিকভাবে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। পরদিন চুয়াডাঙ্গার সকল আঞ্চলিক পত্রিকাসহ কিছু জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার করা হয়।
আকাশের মৃত্যুর কয়েকদিন পর মৃত্যুর ঘটনার নতুন মোড় নেয়। পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। পরিবারের দাবি, একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা টিটিইসহ রেলওয়ে পুলিশ ও এটেনডেন্টরা আকাশকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে বলে নিহত আকাশের পিতা জিন্নাত আলী দাবী করেছেন।
এ ঘটনায় নিহত আকাশের পিতা জিন্নাত আলী বাদি হয়ে গত ২৭ মে ওই ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা ২ জন রেলওয়ে পুলিশ, ১ জন টিটিই এবং ২ জন এটেনডেন্টকে আসামী করে চুয়াডাঙ্গা আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
আসামীরা হলেন- ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা টিটিই লালন চক্রবর্তী (৪২), রেলওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক পারভেজ (৩৬), কনস্টেবল কাদের (৪০), এটেনডেন্ট মিলন (৩৭) ও সোহাগ মিয়া (৩৬)।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গাফফার আলী আকাশ অফিস শেষে প্রতিদিনের মতো কপোতাক্ষ ট্রেনযোগে চুয়াডাঙ্গা থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। ঘটনার দিন কপোতাক্ষ ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা টিটিই, রেলওয়ে পুলিশ ও এটেনডেন্টরা টিকিট না কেটে উঠা যাত্রীদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছিলেন এবং তাদের কাছে অবৈধভাবে অনেক টাকা দাবি করছিলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় রেলওয়ে পুলিশসহ অন্যরা আকাশকে টেনে-হেঁচড়ে দরজার কাছে নিয়ে যায় এবং জয়রামপুর রেল স্টেশনের নিকট দরজা থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এ মামলায় ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী স্বাক্ষীও প্রদান করেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কপোতাক্ষ ট্রেনের একই বগিতে থাকা একাধিক যাত্রীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আকাশ হত্যার সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য আইনের আশ্রয় নিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবার। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষদর্শী এক যাত্রীর সাথে কথোপকথনের কল রেকর্ড হাতে পাওয়া গেছে। রেকর্ডে রাজশাহী থেকে ওঠা ওই ট্রেনের এক যাত্রী বলেছেন, আমরা ওই ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে ৭১ নং সিটে বসে ছিলাম। এক পর্যায়ে দেখতে পাই লাল গেঞ্জি পরিহিত একটা ছেলেকে (আকাশ) বগিতে দায়িত্ব থাকা কয়েকজন লোক টেনে হেঁচড়ে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছে নিয়ে যাওয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ওই ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ছেলেটার মাথা নিচের দিক দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। সেখানে দুইজন পুলিশ উপস্থিত ছিলো। তাদের সামনেই এই ঘটনা ঘটে।
কল রেকর্ডে আরও শোনা যায়, তারা দর্শনা হল্ট স্টেশনে নামার পর ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা কাদের নামের এক পুলিশের কাছে জানতে চায়, ছেলেটার অপরাধ কি ছিলো? পুলিশ কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায়।
নিহত আকাশের ৯ মাস বয়সের একটা পুত্র সন্তান রয়েছে। ঘটনার দিন ছেলের জন্য জুস কিনে বাড়ি ফিরছিলেন আকাশ। রেল লাইনের পাশে আকাশের নিথর দেহের পাশে পড়ে ছিলো জুসের প্যাকেট। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আকাশ অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিলো। তার অকাল মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন এলাকাবাসী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *