মহান মে’ দিবস – ২০২৫ -অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান

প্রতি বছরে মে’ মাস এলেই মনে করিয়ে দেয় সেই অমর স্লোগান-“দুনিয়ার মজদুর এক হও”, সঙ্গে সঙ্গে মনের কোণে ভেসে আসে কবি জীবননান্দ দাশের কবিতার সেই পংক্তিটি- “কোথাও আঘাত ছাড়া, তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই”। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রসাশন যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদ্যাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
আজ মহান মে’ দিবস। মনে পড়ে যায় ১৩৯ বছর আগে ১৮৮৬ সালের আজকের দিনে আমেরিকার শিকাগো শহরে হেমার্কেটের শ্রমিকদের রক্তঝরা সংগ্রাম আর শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের কথা। মে’ এলেই শুরু হয়ে যায় পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখি, সভা-সেমিনার, বক্তৃতা-বিবৃতি, মিটিং-মিছিল-স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার শহর-বন্দর-নগর। আসলে কি পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের যে বিরাট ব্যবধান তার কি সমাধান আজও হয়েছে এই মে’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে? হয়নি। আমাদের দেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে আজও অজস্র শ্রমিকদের তথা বিশেষত নারীদের কম মজুরী এবং ৮ ঘন্টার বেশি সময় হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু সেই একই দাবিতে সেদিন সারা বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণ একাত্বতা ঘোষণা করে স্লোগান দিয়েছিল-“দুনিয়ার মজদুর এক হও” আজও কি সেই আমেরিকার শ্রমিক জন ডেভিড আর আমাদের দেশের খোয়া ভাঙ্গা কুলছুম বিবি’র মজুরি কী এক হয়েছে? শুধুই স্লোগান সর্বস্বই মাত্র। আজকের সমাজ্রবাদী বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় আমেরিকার শিকাগোর কারখানায় সেই শ্রমিক জন ডেভিড মাসে বেতন পান ১ লাখের উপরে অর্থাৎ দিনে ৪ হাজার টাকার বেশি, আর আমাদের ঢাকার খোয়া ভাঙ্গা কুলছুম বিবি দিনে পান ৩০০ টাকা। যা দিয়ে বাল-বাচ্চা নিয়ে দিনে নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যায়। এ অবস্থ্য়া যেমন জন ডেভিডকে শ্রমিক বলা অনুচিত, তেমনি মে মাসের সেই স্লোগান “দুনিয়ার মজদুর এক হও” আজকের দিনে প্রহসন মাত্র। ডেভিড বাস করেন সুরম্য অট্টালিকায়, আর আমাদের কুলছুম বাস করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে হয় ফুটপাতে না হয় অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে। সেখানে নেই কোন ওষুধ, নেই কোন চিকিৎসা, নেই কোন শীতবস্ত্র। এই অবস্থায় কিছুদিন কাজ করতে করতে হয় কুলছুম বিবি মারা যান না হয় রক্তশূন্যতায় বা খাদ্যাভাবে ভোগে। এই তো আমাদের দেশের সাধারণ শ্রমিকদের জীবনযাত্রার চিত্র। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। ধনী-বুর্জোয়াদের লুণ্ঠন, শোষণ আর নিপীড়নে শ্রমজীবী মজদুরদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘুচবে কি কখনও? দেখা যাক, ১৩৯ তম মে’ দিবসে যে বৈষম্য দুর হয়নি, তা আরও ১৩৯ তম দিবস লাগলে যদি সম্ভব হয়! এই আশায় দিনটি যথাযথ গুরুত্বের সাথে নানা বর্ণের বর্ণাঢ্য র‌্যালী, আলোচনা সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে মে দিবস। এ সঙ্গে আমিও দু’কথা লেখার সুযোগ করে নিলাম।
জন ডেভিডের শ্রমিকের কথা নাই বা বললাম। আমাদের দেশের কুলছুম আর অন্যান্য সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ অহরহ শুধু মজুরী থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, তারা এমনকি শ্রমের পরিবেশ এবং নিরাপত্তাও পাচ্ছে না। কিছু দিন আগে বাংলাদেশের অকুপেশনাল সেইফটি হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন, (ওশি)’র এক বার্ষিক রিপোর্টে দেখা গেল, অনিরাপদ কর্মস্থলের কারণে দেশে প্রতিদিন গড়ে দু’জন শ্রমিক পেশাগত দুর্ঘটনায় মারা যায় এবং পঙ্গুত্ববরণ করে প্রায় ১২ জন। এ সংস্থাটির মতে, শুধু ২০০৬ সালে সারা দেশে ৪৯৩৮ জন শ্রমিক কর্মস্থলে নানা রকম পেশাগত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ জন নিহত এবং বাকিরা আহত হয়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, নির্মাণ, জাহাজ ভাঙ্গা, চাউল কল শিল্পেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ এদের সেফটি বলতে কিছুই নেই। যেমন অনেক গার্মেন্টস শিল্পে একটি সিড়ি, আগুন লাগলে বেরোনোর কোন পথ থাকেনা, বাধ্য হয়ে অনেককে প্রাণে বাঁচার আশায় ছাদ থেকেও ঝাপ দিতে হয়েছে। মালিক পক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, যথাযথ মজুরি না দেওয়া, কারণে অকারণে চাকরিচ্যূতি, অনেক সময় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারই ফলশ্রুতিতে অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। অগ্নি সংযোগ, গোলযোগ, মারপিট বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে লেগেই আছে। তার প্রমান সেই আশুলিয়ার তানজিন ফ্যাক্টরির আগুনে পুড়া শ্রমিকের কথা এবং রানাপ্লাজা ধসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার স্মৃতি, এক ব্যর্থতা এবং পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার কথা।
শ্রমিকদের দুর্দশা আমাদের দেশে শুধু যে পোশাক শিল্পেই তা নয়, রাস্তার সুইপার থেকে শুরু করে কমলাপুরের রেলওয়ে কুলি, ডেভেলপারদের নির্মাণ শিল্পে খোয়া ভাঙ্গাসহ সদর ঘাটের মাঝি পর্যন্ত সবারই একই অবস্থা। সর্বত্র শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে নিরপত্তা থেকেও। অথচ শিল্প কারখানার বর্জ্য এসে পড়ছে ম্যানহোলে, আর সুইপার সেই ম্যানহোল পরিষ্কার করতে যেয়ে কখনও কার্বন মনোক্সাইড বা মিথেন গ্যাসের খপ্পরে পড়ে মারা যাচ্ছে। কেউই তখন কোন ক্ষতিপূরণ দিতে এগিয়ে আসে না। এরাও যে মানুষ, এদেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে, একথা তখন বুর্জোয়া শ্রেণি বুঝতে চায় না। এদের পরিশ্রমের ফসলেই তারা ধনী হয়েছে, একথা ভুলে যান তারা।
একটু পরিবহন শ্রমিকদের দিকে নজর দেওয়া যাক, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, যাত্রাবাড়ি, সদরঘাট যেখানেই যায় না কেন, সেখানকার কুলিরা একজন দলনেতার অধীনে কাজ করেন, সারাদিনব্যাপী অনেক ঝুকিপূর্ণ মালামাল উঠানো-নামানো করে, কিন্তু যখন কোন দুর্ঘটনায় মারা যায় বা কোন দুর্ঘটনায় পড়ে তখন কেবল মাত্র ঐ দলনেতাই তার পাশে এসে দাড়ায়, সরকার বা টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ কেউই কিন্তু তার পাশে আসে না। পরিবহন মালিকরা কিঞ্চিৎ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে কখনও কখনও। যাত্রাপথে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ধরা পড়ে যায় চালক, হেলপার বা কন্ডাক্টার। সব দায় যেন এদের। রাস্তায় বা যানবাহনে বা মালিকপক্ষের যেন কোন দায় নেই। আরও দেখা যায় রাস্তায় গাড়ির মধ্যে ডাকাতির কবলে পড়লে, সেই দায়ও গিয়ে পড়ে ঐ চালক, হেলপার বা কন্ডাক্টার’র ওপর। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ মালিকপক্ষের যেন কোন দোষ নেই। আর এদের বেতন, সেটাও নির্ভর করে মালিকদের ওপর, ভাবটা এমন নাও নাও না হলে কেটে পড়। এই তো পরিবহন শ্রমিকদের হালহকিকত। লঞ্চ শ্রমিকদের অবস্থাও একই রকম। লঞ্চে ইঞ্জিনরুমে কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছর অনেকের হাত, পা, চক্ষু হারিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েছে, কেউ দেখেনি এদের! মালিক পক্ষের রক্তচক্ষু ও স্বল্প বেতনে তারা খাবে-পরবে না চিকিৎসা সেবা নিবে, তারাও ভাল নেই। জাহাজের শ্রমিকরাও স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে থাকেন। পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গার সময় যেমন স্বাস্থ্য ঝুকি, পরিবেশ দূষণ, বিভিন্ন কেমিকেল ও রঙের গন্ধে শ্রমিকরা শ্বাসকষ্টে পড়েন। এমনকি ফুসফুস ক্যান্সারে ভোগেন। এতবড় ঝুকির মধ্যে তারা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক কখনও পায় না। আর এই কারণেই শ্রমিকদের কাছে আমরা যাত্রীরা ঠিকমত সেবা পাই না।
মাত্র ১২ বছর বয়স। নারী শিশু শ্রমিক, নাম ময়না। ফজরের আযান দেওয়ার আগেই উঠতে হয় তাকে। সবাই ঘুমিয়ে আছে। ময়না তখন অন্যের বাসায় হাড়ি-পাতিল ধোয়া থেকে শুরু করে পানি আনা, টেবিল মোছা, নাস্তা তৈরিসহ মাছ কাটা, তরিতরকারি কাটা নানা কাজের মধ্য দিয়ে দিন শেষ করে দেয়। দিনে বিশ্রামের সুযোগ নেই। রাতে সবার শেষে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। আবার রাত শেষ না হতেই শুরু হয় সেই রুটিন বাধা কাজ। এতদসত্ত্বেও বাড়ির গৃহিনীর বকাবকিসহ শারিরীক নির্যাতন ভাগ্যে প্রায় প্রতিদিনই থাকে। পেট পুরে খাওয়াটাও দিতে চায় না গৃহিনীরা। এত খাটুনির পর খাওয়া-দাওয়া বাদে মাসে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা পায়। অন্য দিকে ১২/১৩ বছরের ছেলে শ্রমিক, রাজু লেদ মেশিনে কাজ করে। অনেক সময় লোহার গুড়া চোখের মধ্যে চলে যায়। এভাবে কত ময়না, কত রাজু শিশু শ্রমিক যে বাড়ি-বাড়ি, দোকানে-দোকানে, ইট ভাঙ্গা, পুরাতন ব্যাটারি ভাঙ্গা, দর্জির দোকান, ওয়েল্ডিংয়ের দোকান, ফ্রিজ মেরামতের দোকান, চায়ের দোকানে, রিক্সা চালানো, রাস্তার পাশে ফুল বিক্রি, কাগজ বিক্রি ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে আছে। তার হিসেব কে রাখে। এসব শিশু শ্রমিকদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করেই যাচ্ছে। বিনিময়ে মাসে ২০০০/৫০০০ টাকা পেয়ে থাকে। মূলত শিশু শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ করাই আইনে বাধা আছে। কে আইন মানে? আমাদের দামাল ছেলেরা প্রবাসে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে যেমন, তেমনি অনেক শ্রমিক বিদেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যারা অবৈধ পথে কিংবা দালালচক্রের মাধ্যমে এমনকি দুষ্টু এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে গেছেন। তাই শ্রমের মর্যাদার প্রতি সকলেরই যত্নবান হওয়া দরকার।
অবশ্য একথা বলতে দ্বিধা নেই। আমাদের দেশের অনেক শ্রমিক কাজে ফাঁকি দেয়। আমাদের বাসাতেও মাঝে মধ্যে নির্মাণ শ্রমিককে কাজে লাগালে দেখা যায় সকাল ৯টায় আসে, অথচ ২টা বাজার আগেই যন্ত্রপাতি গুছাতে থাকে, যেখানে ন্যূনতম ৮ ঘন্টা কাজ করবার নিয়ম আছে। এধরনের শ্রমিকদের প্রতি মালিক পক্ষের সহানুভূতিশীল না হওয়ারই কথা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের কথা শোনা যায়। বাস্তবে কি তার প্রতিফলন দেখা যায়? একজন নাগরিকই পারে তার অধিকার সংরক্ষণ করতে। এই অবস্থার পিছনে যে সকল নীতিমালা যেমন, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা, সুষ্ঠু পরিবেশ, ঝুকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা, সবকিছু একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। জনবহুল দেশে সব সেবাই সরকার দিতে পারে না। অথচ নাগরিক সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ে।
আমাদের দেশে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনের মধ্যে উল্লেখ্য হল ১৯২৪ সালের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা, ১৯৬১ সালের নিম্নতম মজুরি অধ্যাদেশ, ১৯৬৫ সালের শ্রমিক নিয়োগ আইন, ১৯৬৮ সালের শ্রমিক নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ ও ১৯৭৭ সালের মজুরি পরিশোধ আইন। এই অধ্যাদেশগুলোর মাধ্যমে শ্রমিকরা শিল্প-কারখানা মালিকদের কাছ থেকে কি ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন তাই বলা হয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলো কোন এলাকায় হবে, চারপাশের পরিবেশ কেমন বা স্থাপনার ক্ষেত্রে কি কি বিধিমালা অনুসরণ করা হবে তা কিন্তু নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। যদিও এসবের জন্য আলাদা বিধিমালা রয়েছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কেও বিধান রয়েছে। আসলে এর প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খুরূপে হচ্ছে না। এমনকি শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ সম্পর্কে বেশ কিছু আইন আছে, কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। ১৯৬৫ সালে পরিবেশ আইনগুলোর কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হল, যেমন-
১২(১) (খ) উপধারা মতে, শ্রমিকদের কাজ করার কক্ষ প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন পানি ও অথবা জীবননাশক বা অন্য কোন কার্যকর পন্থায় পরিষ্কার করতে হবে।
১৯(১) উপধারা মতে, প্রত্যেক কারখানার শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য যথোপযুক্ত স্থানে সর্বক্ষণ বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১৯(২) উপধারা মতে, খাবার পানি রাখার জায়গায় অধিকাংশ শ্রমিকের বোধগম্য ভাষায় “খাবার পানি” কথাটি লিখতে হবে এবং মুখ্য ইন্টপেক্টরের অনুমতি ছাড়া ঐ স্থানে ২০ ফুটের মধ্যে কোন শৌচাগার, প্রসাব বা পায়খানা থাকতে পারবে না।
২২(১) উপধারা মতে, প্রত্যেক কারখানায় অগ্নিকান্ড থেকে নিরাপদে বহির্গমনের জন্য নির্ধারিত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২২(৬) উপধারা মতে, প্রত্যেক কারখানায় প্রতি কামরায় অগ্নিকান্ডের সময় শ্রমিকদের বের হওয়ার উপযুক্ত বহির্গমন পথের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২৫(১) উপধারা মতে, যন্ত্র সংক্রান্ত নিরাপদ এবং তা থেকে সতর্কতা অবলম্বন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ না দেওয়া পর্যন্ত কোন তরুণ শ্রমিককে কোন যন্ত্রের কাজ করতে দেওয়া যাবে না।
৪৪(৪) উপধারা মতে, ৫০০ তদোতিরিক্ত সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে এরকম প্রত্যেক কারখানায় নির্দিষ্ট চিকিৎসার সরঞ্জামাদিসহ নির্ধারিত আকারের একটি এ্যাম্বুলেন্স, কক্ষ বা ডিসপেনসারি সরঞ্জামাদিসহ চিকিৎসক ও নার্সিং ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৫০(১) উপধারা মতে, কোন কারখানায় কোন প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিককে সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি কাজ করতে বলা যাবে না বা কাজ করানো যাবে না।
শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আইনে বলা আছে, কোন শ্রমিক মাত্র দু’দিনের জন্য নিযুক্ত হলেও মালিকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকারী হবেন। এই আইনের ৪ ধারার বিধান মোতাবেক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য।
আইনগুলো কাগজে-কলমে থাকলেও সময়ের বিচেনায় অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হলে আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা প্রয়োজন। অন্যথায় এই আইনগুলো কোন উপকারেই আসবে না এবং মালিকদের প্রতি শ্রমিকদের অসন্তোষ দিন দিন বাড়বে বৈ কমবে না। এজন্য মালিক, শ্রমিক, সরকার তিন পক্ষকেই এক্ষত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে। মালিকদের বুঝতে হবে শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রম দিয়েই আজ তারা অনেক বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। সরকারকেও এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, লাখো-কোটি শ্রমিকদের কষ্টসাধ্য শ্রমের বিনিময়েই সচল রয়েছে বিশ্বের অর্থনৈতিক চাকা। অশিক্ষা, অদক্ষতা, কর্মক্ষেত্রে নানান অনিয়ম, দুর্নীতি, শোষণ, চাকরির অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন কারণে শ্রমিকরা তাদের শ্রমের মর্যাদা থেকে সবসময় বঞ্চিত হয়ে আসছে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরেও তাদের জীবন যাত্রায় আধুনিকতার কোন ছোয়া লাগেনি। তবে আমাদের দেশের অনেক শিল্প ও কলকারখানার পরিবেশসহ শ্রমের মর্যদার কিছু উন্নতি হয়েছে। আসুন সমাজের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরকরে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করি এবং “শ্রমিক মালিক ঐক্য গড়ি, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলি”- এই শ্লোগানকে সফল করি।

লেখক ঃ
অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান
সাবেক অধ্যক্ষ চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ও
দর্শনা সরকারি কলেজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *