হাসান নিলয়, জীবননগর
শীত আসতে না আসতেই হেমন্তের শুরুতে রস আহরনের জন্য খেজুর গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জীবননগর উপজেলার গাছিরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছিরা খেজুর গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও চাঁছাছোলা করে যাচ্ছে। এই উপজেলায় ফসলের মাঠে,সড়কের পাশে ও বসত বাড়ির আঙ্গিনায় আছে অসংখ্য খেজুর গাছ। শীত আসার আগেই খেজুর গাছ গুলো প্রস্তুত করে রাখে গাছিরা।শীত পড়ার সাথে সাথে গাছ গুলো থেকে রস সংগ্রহ করে তারা।এই রস জ্বালিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরি করা হয়। খেজুরের গুড়,তাতরস ও রস থেকে হয় নানা পিঠাপুলি।জীবননগর উপজেলার অনেক কৃষকই এই পেশার সাথে জড়িত। এ বছর এ উপজেলা থেকে ৭ কোটি টাকার ওপরে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সুস্বাদু এ গুড় নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে সরবরাহ করা হবে। ইতোমধ্যে গাছিরা হাতে দা আর কোমরে দড়ি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাঁছাছোলা ও নলি বসানোর কাজ করছেন। ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি বেঁধে খেজুরের গাছ প্রস্তুত করছেন তারা।
রখজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ অঞ্চলের গাছিরা। তাদের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। শীতের দিন মানেই খেজুর রস ও নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধ। শীতের সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে বোঝানো যায় না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো খুবই মজাদার। এ কারণে শীত মৌসুমের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের পায়েস ও পিঠে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়িতে খেজুর রসের তৈরি খাদ্যের আয়োজন চলে। শীতের সকালে বাড়ির উঠানে বসে সূর্যের তাপ নিতে নিতে খেজুরের মিষ্টি রস যে পান করেছে, তার স্বাদ কোনো দিন সে ভুলতে পারবে না। শুধু খেজুরের রসই নয় এর থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু পাটালি, গুড় ও প্রাকৃতিক ভিনেগার। খেজুর গুড় বাঙালির সংস্কৃতিক একটা অঙ্গ।
জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, ৩ দিন হয়েছে কাজ শুরু করেছি। গাছের ময়লা ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এর পর আরেকবার চাঁছাছোলা হবে।তার সপ্তাহ খানিক পরে থেকে নলি স্থাপনের কাজ শুরু হবে। কিছুদিন পরই গাছে লাগানো হবে মাটির পাতিল। এর পরই শুরু হবে সুস্বাদু খেজুর রস সংগ্রহের কাজ।
দেহাটি গ্রামের গাছি সাজ্জাদ হোসেন জানান, শীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস। আর সপ্তাহ দুইয়েক পর গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর্ব শুরু হবে। তার নিজের রয়েছে ৬০টি গাছ। আরও ৪০টি গাছ তিনি বর্গা নিয়েছেন। গাছ একবার ছাঁটলে তিন-চার দিন রস সংগ্রহ করা যায়।
নাজিমউদ্দীন নামের এক গাছি জানান, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে তাতে এক সময় হয়তো আমাদের দেশে খেজুর গাছ থাকবে না। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত তালগাছের মতো বেশি বেশি খেজুর গাছ লাগানো এবং তা যত্ন সহকারে বড় করা।
গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্য খেজুর রস ও গুড় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার কারনে আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিদিন ইটভাটায় জ্বালানির কাজে নিধন হচ্ছে এলাকার শত শত খেজুর গাছ। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর পরও গাছিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান সরকার জানান, জেলায় এ বছর রস সংগ্রহের জন্য ২ লাখ ৭২ হাজার খেজুর গাছ প্রস্তুত করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে এসব গাছ থেকে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, সারা দেশেই এ জেলার গুড়ের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। এবারও আশাকরি জেলায় গুড়ের চাহিদা মিটিয়ে খেজুরের গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে জায়গা করে নিবে। শীতকালীন মৌসুমি এ পেশায় জেলার প্রায় ৩০ হাজার চাষি সম্পৃক্ত রয়েছে।