কেরুজ চিনিকলের জৈব সার প্রকল্প: কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত

দর্শনা অফিস


বর্জ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব জৈব সার কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষের আকন্দবাড়িয়া কারখানায় তৈরি পরিবেশবান্ধব জৈব সার। এতে একদিকে বন্ধ হয়েছে নদী দূষণ, অন্যদিকে বেড়েছে ফসলের গুণগত মান ও উৎপাদন। কেরুজ চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন মাথাভাঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া হতো প্রেসমাড ও ডিস্টিলারি ইউনিটের বর্জ্য পদার্থ।
দীর্ঘদিনের পরিবেশ দূষণের অভিযোগ পেরিয়ে কেরুজ চিনিকল আজ নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির উপজাত বর্জ্য পদার্থকে ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব জৈব সার উৎপাদন এখন কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। একসময় মাথাভাঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া এসব বর্জ্য আজ দেশের কৃষি উৎপাদনে সহায়ক উপকরণে পরিণত হয়েছে।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দে প্রায় ৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আকন্দবাড়িয়া বীজ উৎপাদন খামারের ২.৮৩ একর জমিতে শুরু হয় সার কারখানার নির্মাণকাজ। ভারতের টরিও চিম টেকনো লিগাল সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের কারিগরি সহায়তায় ২০১৩ সালের মে মাসে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয় এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে রূপ নেয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০১৫ সালের ১৭ এপ্রিল।
প্রাথমিক পর্যায়ে বার্ষিক ৯ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্য থাকলেও জমি স্বল্পতার কারণে তা সমন্বয় করতে হয়। তবুও উৎপাদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং স্থানীয় বাজারে জৈব সারের চাহিদা উল্লেখ যোগ্যভাবে বাড়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নির্ধারিত ১,২০০ মেট্রিক টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয় ১,৬২০ মেট্রিক টন, যার মধ্যে বাজারজাত করা হয় ১,১৮৮ মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১,২০০ মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন দাঁড়ায় ১,৬৩০ মেট্রিক টন—লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪৩০ মেট্রিক টন বেশি। এতে মুনাফার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কারখানার প্ল্যান্ট ম্যানেজার জাকির হোসেন জানান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ১,৪০০ মেট্রিক টন ধরা হলেও তা অতিক্রম হবে বলে তারা আশাবাদী। বর্তমানে কেরুজ চিনিকলের প্রেসমাড এবং ডিস্টিলারি ইউনিটের স্পেন্ট ওয়াসই এই জৈব সারের প্রধান কাঁচামাল। প্রতিবছর প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন প্রেসমাড এবং ৪০ হাজার মেট্রিক টন স্পেন্ট ওয়াস ব্যবহার করা হয়। কেরুজ থেকে প্রাপ্ত কাঁচামালের ঘাটতি মেটাতে অন্যান্য চিনি কারখানা থেকেও সংগ্রহ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসায়নিক সারের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে জমির উর্বরতা কমে যায় এবং বিষাক্ততা বেড়ে যায়, যার ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। কিন্তু কেরুজের জৈব সার ব্যবহারে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, বিষাক্ততা দূর হয় এবং ফসলের গুণগত মান উন্নত হয়। বর্তমানে ৫০ কেজির প্যাকেটপ্রতি দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫০ টাকা এবং অনুমোদিত লাইসেন্সধারী বিক্রেতাদের মাধ্যমে কৃষকরা এই সার সংগ্রহ করতে পারছেন।
স্থানীয়দের মতে, কারখানাটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু হওয়ায় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাথাভাঙ্গা নদীর পানি এখন দূষণমুক্ত থাকছে। একই সঙ্গে দেশের কৃষি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পথ সুগম হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *