চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহে বিষাক্ত মদ পানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাড়ালো ৭  এলাকায় শোকের ছায়া ॥ মদ বিক্রেতা জুমাত আলী আটক ॥ ৯/১০ জনের নামে থানায় মামলা

স্টাফ রিপোর্টার

চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহে বিষাক্ত মদ পান করে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাড়ালো ৭ জনে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিষাক্ত এ মদ পানের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে প্রশাসনে শুরু হয়েছে তোলপাড়। পুলিশ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জুমাত আলী নামে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। মদ পানে মৃত্যুর ঘটনায় রাকিবুল বাদী হয়ে গতকাল রাতে ৬ জনের নামউল্লেখ করে ৯/১০ জনকে আসামী করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। এদিকে লাল্টু ও সমিরের মরদেহ ময়না তদন্ত করে পরিবারের কাছে দেয়া হয়েছে।

জানা যায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ৯/১০ জন লেবার একত্রিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহ বাজারে মেয়াদউত্তীর্ণ মদপান করে। পরে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর একে একে মারা যায় ৭ জন।

মদপানে নিহতরা হলেন,  নফরকান্দি পূর্ব পাড়া গ্রামের খেদের আলী, নফরকান্দি গ্রামের হায়াত আলী, খেজুরা গ্রামের হাসপাতাল পাড়ার মাছ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সেলিম,  পিরোজখালী স্কুল পাড়ার ভ্যানচালক লাল্টু ওরফে রিপু , শংকরচন্দ্র গ্রামের মাঝের পাড়ার লেবার শহীদ, ডিঙ্গেদহ টাওয়ার পাড়ার মিল শ্রমিক সমির ও ডিঙ্গেদহ পাওয়ার হাউজ পাড়ার লেবার সর্দার লাল্টু। অপরদিকে হানুরবাড়াদি গ্রামের মৃত কাতব আলীর ছেলে অসুস্থ অলিউদ্দিন (৫০) কে উন্নত চিকিঃসার জন্য রাজশাহী পাঠানো হয়েছে। 

 এ ঘটনায় মদ বিক্রেতা সন্দেহে খেজুরা গ্রামের বাকী শেখের ছেলে জুমাত আলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। পরে তাকে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়। তিনি অসুস্থ বোধ করায় তাকেও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পদ্মবিলা ইউনিয়নের নফরকান্দি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মদ্যপানে মাছ ব্যবসায়ী খেদের আলীর মৃত্যুতে নফরকান্দি গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পরিবারের সদস্যদের দাবি স্ট্রোক করেই মারা গেছেন খেদের আলী। চার কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। মাছের ব্যবসা করেই চলতো তার সংসার।

তার বড় মেয়ে বলেন, দীর্ঘদিন যাবত আমার বাবা পেটের ব্যথাজনিত রোগে ভুগছিলেন। চুয়াডাঙ্গা বর্ডার গার্ড হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। হাসপাতালে যাওয়ার পথেই আমার বাবার পাঁচ হাজার টাকা হারিয়ে যায়। এই বিষয়টি নিয়ে আমার বাবা একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। এসব চিন্তায় তিনি স্ট্রোক করে রাস্তায় পড়ে যান। পরে শুক্রবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে তিনি মারা যান। আমার বাবা মদ পান করেনি।

মৃত খেদের আলীর প্রতিবেশী বলেন, খেদের আলী আমার প্রতিবেশী ছিলেন। আমরা দেখে আসছি অনেকদিন ধরে তার পেটে ব্যথা। অসুস্থ অবস্থায় কাজকর্ম করে বেড়ান। মাঝেমধ্যে হাসপাতালে যেতেন চিকিৎসার জন্য। গত পরশু হঠাৎ সে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পরে স্যালাইন দেওয়া হয়। তার কিছুক্ষণ পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কোন নেশাভানে আসক্ত ছিলেন না। আমরা আজও পর্যন্ত তার কোন নেশা করতে দেখিনি। আমি যতটুকু জানি, তিনি গত পরশু সন্ধ্যা রাত থেকে অসুস্থ গতকাল অসুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি পড়ে যান।  সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

ডিঙ্গেদহ পাওয়ার হাউস পাড়ার মৃত লাল্টুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, লাল্টুর মৃত্যুতে এলাকায় শোকাবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। লাল্টুর লাশটি তখনো চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা ছিল। মৃত লালটুর স্ত্রী মোছাঃ রেহেনা খাতুন কান্নারত অবস্থায় বলেন, আমার স্বামী শনিবার দুপুরে বাড়ি থেকে বের হয়। শনিবার রাতে তিনি বাড়িতে আসেনি। রবিবারে সকালে আমার স্বামী বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসে বলে আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমার মাথায় পানি ঢালো। মাথায় পানি ঢালার পর আরো দু-তিনবার পানি ঢালতে বলে। পরবর্তীতে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডিঙ্গেদহ বাজারে বারিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখান থেকে দুপুর একটার দিকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারি আমার স্বামী মদ পান করেছেন। আমার স্বামী এর আগে মদ পান করেনি।

মৃত লাল্টুর মা মোছা: হালে বেগম বলেন, আমার ছেলে শনিবার দুপুরে ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ওই রাতে আর বাড়িতে ফেরেনি সে। রবিবার সকালে বাড়িতে এসেছে বাড়িতে এসেই আমার ছেলে গোসল করতে চলে গেছে। গোসল করে এসে শুয়ে পড়েছে। আবার একটু পর উঠে গোসল করতে চলে গেল। গোসল করে এসে আমার ছেলে আমাকে ডাকাডাকি শুরু করল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? সে আমাকে বলল আমার ভালো লাগছে না। এই কথা বলে আবার আমার ছেলে গোসল করতে চলে গেল। পরে ওকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। তারপর শুনি আমার ছেলে আর বেঁচে নেই।

চুয়াডাঙ্গায় মদ্যপানে ৭ জনের মৃত্যুতে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মদ্যপানে একসঙ্গে এতজনের মৃত্যুর ঘটনা এর আগে কেউ দেখেনি। এলাকাবাসীরা মদ বিক্রেতাকে আটকের জোর দাবি জানান। এদিকে পরক্ষণেই পুলিশ অভিযান চালিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মদ বিক্রেতা সন্দেহে জুমাত আলীকে আটক করেন। আটককৃত জুমাত আলী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পদ্মবিলা ইউনিয়নের খেজুরা গ্রামের আব্দুল বাকী শেখের ছেলে।

চুয়াডাঙ্গা সদর থানার পরিদর্শক মো: হোসেন আলী বলেন, প্রাথমিক তদন্তে অনুসন্ধানকালে তাদের মৃত্যুর কারণটা অ্যালকোহল পানেই হয়েছে। হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা জানায় অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ খেয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। হাসপাতালে ডাক্তার একজনের মৃত্যুর সার্টিফিকেটে অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে বলে উল্লেখ করেন। এই ঘটনার ব্যাপারে প্রাথমিক পর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা পুলিশ হেফাজতে নিয়েছি। পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরো জানান, মদ পানের ঘটনায় নিহত লাল্টুর ভাই ডিঙ্গেদহ পারহাউজ পাড়ার শামসের আলীর ছেলে রাকিবুল বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় জুমাত আলীসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ৩/৪ জনকে অজ্ঞাত দেখানো হয়েছে। মামলা দায়েরের পর পুলিশ আসামীদের ধরতে অভিযানে নেমেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *