ঝিনাইদহ অফিস
ঝিনাইদহ শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দুরে, প্রায় ১২ বিঘা আয়তনের ২টি পুকুরের চারপাশে সারি সারি গাছ। গাছের প্রতিটি ডালে ডালে বাসা বেঁধেছে এশিয় শামুক খোল, পানকৌড়ি ও সাদা সারস পাখি। প্রায় ১০ হাজার পাখির এই আবাসভূমিকে দেখলে হংকংয়ের মনস্টার বিল্ডিংয়ের মতো মনে হতে পারে। দিন কিংবা রাত পাখিগুলো ব্যস্ত বাসা তৈরি, ডিমে তা দেওয়া ও বাচ্চাদের খাওয়াতে। দুই পুকুরের মাঝখান দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় ইঞ্জিনচালিত যানবাহন কিংবা মানুষের কোলাহল তাদের কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলতে পারে না। এই গ্রামের মানুষগুলোও যেন তাদের সেবায় নিয়োজিত। বাসা থেকে বাচ্চা পড়ে গেলে তারা আবার উঠিয়ে দেয় বাসায়।
এমনই এক দৃশ্যের দেখা মিলবে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের আশুরহাট গ্রামে। এই গ্রামের সনাতনী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস পাড়ার গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস ও রাজ্জাক মিয়ার পৃথক দুটি পুকুর ঘিরে পাখিদের এই রাজত্ব। শীতকালে এখানে আসে অতিথি পাখি। তবে এই বর্ষাকালে এখানে প্রজণনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে এশিয় শামুক খোল, পানকৌড়ি ও সাদা সারস পাখি। আশপাশের বিল-খালে সারাদিন ঝাকে ঝাকে খাবার খোঁজে আর এখানে ফিরে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বংশ বিস্তারে। এসব পাখিদের প্রধান খাবার শামুক, ছোট মাছ ও জলজ পোকামাকড়। এবারের ভারি বৃষ্টিতে মাঠের পর মাঠ পানিতে একাকার। সেখানেই তাদের খাদ্যের সমাহার।
এশিয় শামুক খোল পাখি মূলত বর্ষাকালে পর্যাপ্ত খাবারের মজুদ আছে এমন এলাকায় প্রজণন করে। এরা ৩ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে। তবে পানকৌড়ি ৬ থেকে ৮টি ডিম পাড়ে। সারস পাখি আরও বেশি ডিম পাড়ে। এরা সবাই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। আশুরহাট গ্রামের এই জায়গাটিতেই গত প্রায় ১০ বছর ধরেই এভাবে অতিথি পাখিরা বসবাস করে। তবে এবছরই এতো বেশি শামুক খোল পাখি এখানে আবাস গড়েছে।
বন্য প্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ খুলনা এই এলাকাটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে নিয়মিত গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে পাহারা দেওয়া হয় এবং ২০১৭ সাল থেকে এখানে পাখি সংরক্ষণ সমিতি গঠন করা হয়েছে। এই গ্রামে শিকারিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে দর্শনার্থীরা প্রতিদিনই পাখি দেখতে আসে এখানে।
পুকুর পাড়ের বাসিন্দা পল্টন বিশ্বাস বলেন, ১০/১২ বছর ধরে এখানে পাখি আসে। বাসা তৈরি করে বাচ্চা তোলে। বাচ্চা বড় হলে চলে যায়। এখানে কেউ পাখি মারে না। বাসা থেকে বাচ্চা পড়ে গেলে আমরা বাসায় উঠিয়ে দিই। অনেক মানুষ প্রতিদিনই পাখি দেখতে আসে। তবে শুক্রবারে বেশি আসে।
এখানে আসা দর্শনার্থীদের জন্য ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ থেকে তৈরি করা হয়েছে একটি ছাউনী। সেখানে পানি পানের জন্য স্থাপন করা হয়েছে টিউবওয়েল ও টয়লেট। এখানকার আরেক বাসিন্দা রুপিয়া খাতুন বলেন, ২/৩ মাস আগে সরকার থেকে এখানে বসার জন্য ঘর বানিয়েছে। অনেকেই এখানে পাখি দেখতে আসে। পাখি দেখে তারা খুব আনন্দ পায়।
স্থানীয়রা জানান অনেক দূর দুরান্ত থেকে এখানে পাখি দেখতে দর্শনার্থীরা ভীড় জমায়, একটা সময় আমাদের এই গ্রাম কেও চিনতো না এখন বাংলাদেশের অনেক যায়গাতে আমাদের গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে এটা আমাদের জন্য গর্ভের বিষয়। পাখি আসাতে গ্রামের সৌন্দর্যটা অনেক বেড়ে গেছে কিন্তু বর্তমানে পাখির কারনে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পথচারীদের কারণ ছাতা মাথায় ছাড়া এই রাস্তা দিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছাতা ছাড়া চলাচল করলে পাখিদের মলত্যাগের কারনে নস্ট হচ্ছে জামাকাপড় ব্যাঘাত ঘটছে প্রোয়োজনীয় ব্যাস্ততার। তারা আরো বলেন পাখি আসাতে আমাদের গ্রামের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে, এই সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে হলে এই রাস্তার উপরে গাছের নিচ দিয়ে ছাউনি দিতে হবে এবং রাতের আধারে কেও যেনো পাখি শিকার না করতে পারে সে জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যাবস্থা করতে হবে যেটা কোনো ব্যক্তি মালিকানার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি এ ধরনের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে গ্রামের সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানুষের সাময়িক ভোগান্তি দূর হবে।
পাখি সংরক্ষণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি বাড়ি থাকলে এখানেই থাকি। সমিতির সদস্য ২৫ জন। আমার ছেলেরাও পাহারা দেয়। তবে রাতের বেলা কিছু শিকারী এখানে আসছে। আগের মতো প্রশাসনিক তৎপরতা নেই। আমরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের সাথে কথা বলবো। আমরা সরকারকে বহুবার লিখিতভাবে এই জমি অধিগ্রহণ করে অভয়ারণ্য ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছি। ব্যক্তি মালিকানা হওয়ায় গতবছর বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সমিতির মাধ্যমে আমরা দুইটা স্থানে নেট দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আর যেন কেউ গাছ কাটতে না পারে সেই বিষয়ে প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে। এছাড়া পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর টহলের দাবি জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, আমি চিরদিন বেঁচে থাকবো না। আমি না থাকলে পাখি গুলোকে দেখবে কে? সরকার উদ্যোগ নিলে বা অভয়ারন্য ঘোষণা হলে এখানে চিরকাল পাখিদের রাজত্ব থাকবে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের তৎপরতা কামনা করেন তিনি।
শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নিগ্ধা দাস বলেন, সেখানে প্রতিদিনি গ্রাম পুলিশ টহল দেয়। কেউ পাখি শিকারের চেষ্টা করলে আমরা তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
বন্য প্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ খুলনার বন্যপ্রাণি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা তন্ময় আচার্য্য বলেন, আমরা এটাকে পাখি কলোনি বানানোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছি। ওখানে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব নিজ উদ্যোগেই জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সম্মত আছেন কিন্তু আরেক পুকুরের মালিক গোপাল চন্দ্র বিশ্বাসের আপত্তি থাকায় হচ্ছে না। আমরা তাদেরকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এখান থেকে এই জমি দিয়ে অন্য জায়গা থেকে সরকারি জমি নিতে। তারা পরিবারের সাথে আলোচনা করে জানাবেন বলে পরে আর জানাননি। এছাড়া আমরা কয়েক বছর আগে এখানে অস্থায়ী আনসার ক্যাম্প বসিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেটা নাই। আমরা আবার স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবো।