মেহেরপুর অফিস
ভূয়া বিল ভাউচারে ২৮ লাখ ৪৮ হাজার ২৭৮ টাকা তুলে বদ হজম হয়েছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনসুর রহমানের। অবশেষে লোক দেখানো কাজ করে আত্মসাৎকৃত টাকা হজম করার চেষ্টা করছেন তিনি। গাংনীর ভাটপাড়া ডিসি ইকোপার্কের ছয়টি উন্নয়নমূলক প্রকল্পে কাজ না করেই টাকা উত্তোলন করে নিজের পকেটে নিয়েছিলেন। আর প্রকল্পের পিআইসি (প্রকল্প কমিটি) সভাপতিকে দিয়ে স্বাক্ষর করাতে দিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার টাকা। আর টাকা আত্মসাৎ করার সুযোগটি পেয়েছেন পিআইসির ব্যাংক একাউন্টে বিল না দিয়ে অফিস স্টাফ দিয়ে নগদ টাকা তুলিয়েছিলেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনসুর রহমান।প্রাপ্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচি আওতায় উপজেলা সাহারবাটি ইউনিয়নের ভাটপাড়া ডিসি ইকোপার্কে শিশু পার্কে রাইড স্থাপন, ফেন্সিং করণ ও রংকরণ বাবদ বরাদ্দ ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, পার্কে ওয়াশরুম সংস্কার ও পিকনিক সেড মেরামত বাবদ বরাদ্দ ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, পার্কে অস্থায়ী দোকান সেড নির্মাণ বাবদ বরাদ্দ ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, ওয়াল প্লাস্টার ৩ লাখ ৯৮ হাজার ২৭৮ টাকা। এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (কাবিটা) কর্মসূচি আওতায় ডিসি ইকোপার্কের শিশুপার্ক থেকে বধ্যভূমি পর্যন্ত কাজলার পাড় এইচবিবি করণ ও দোকানের সামনের মাঠে মাটি ভরাট করণ বাবদ বরাদ্দ ৮ লক্ষ টাকা, পার্কের প্রধান গেট নির্মাণ ও গেটের পাশের মাটি ভরাট করণ বাবদ ৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজ না করেই অর্থ উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া গেছে, শিশু পার্কের রাইড স্থাপন ফেনসিং করন ও রংকরন প্রকল্পের আড়াই লাখ টাকা গত ২৮ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে বিল উত্তোলন হয়েছে, ওয়াশরুম সংস্কার ও পিকনিক স্পটের শেড নির্মাণ কাজের তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকার বিলও একই তারিখে উত্তোলন হয়েছে, অস্থায়ী দোকান শেড নির্মাণ বিল তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা এই একই তারিখেই উত্তোলন হয়েছে, শিশু পার্ক হইতে বৌদ্ধভূমি পর্যন্ত এবং কাজলার পার হতে আশ্রায়ন মুখী রাস্তায় এইচবিবি করণ, দোকানের সামনে মাটি ভরাট করন কাজের মোট আট লক্ষ টাকা বিল উত্তোলন করা হয়েছে কয়েক দফায়, ১৩ মার্চ ২০২৫ ইং তারিখে ৪ লাখ, ২৮ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে দুই লাখ, ১৯ জুন ২০২৫ ইং তারিখে দুই লাখ, ডিসি ইকো পার্কের প্রধান গেট নির্মাণ ও পাশে মাটি ভরাটকরণ কাজের বিল উত্তোলন করা হয়েছে ৭ লাখ টাকা। গত ১৩ মার্চ ২০২৫ তারিখে তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ইং তারিখে এক লাখ ৭৫ হাজার, ১৯ জুন ২০২৫ ইং তারিখে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের টাকা চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে প্রকল্পের টাকা উত্তোলন শুরু হলেও কাজ না করেই পকেটস্থ করতে গিয়ে বদহজম হয়েছে পিআইও মনসুর রহমানের। তাই অর্থ বছর শেষ করে এখন কাজ করছেন নামমাত্র। তবে দফাই টাকা উত্তোলন হলেও টাকা বা কাজের বিষয়ে কিছুই জানতেন না পিআইসি।
সরজমিনে দেখা যায়, ইকো পার্কের ভিতর উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কিছু কাজই চলমান রয়েছে যা দুই মাস আগেই শেষ হওয়ার কথা। পিকনিক কর্ণারের শেডে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের রড ও এইচবিবি করণ কাজ সামান্য অংশ করা হলেও ইটের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সর্বমোট ২৮ লাখ ৪৮ হাজার ২৭৮ টাকা বরাদ্দের এই কাজে হরিলুট করে উত্তোলনকৃত অর্থ নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমান।
গাংনী শহরের লাকি খাতুন জানান, ভাটপাড়ায় কাদায় পার্কে দাঁড়ানোর উপায় নেই, এখানে পর্যটকদের উপভোগ করার মত কিছুই নেই। স্থানীয় দোকানদার শফিকুল ইসলাম জানান, শেডগুলো নির্মাণ হলে খুবই ভালো হয়। সৌন্দর্য বর্ধন এর পাশাপাশি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এই পার্কের।
স্থানীয় নওপাড়া বাজারের মোটর মেকানিক মশিউর রহমান জানান, পার্কটা প্রথম প্রথম ভালই চলছিল। এখন আর লোকজন ঠিকমতো আসছে না কারণ এই পার্কের মধ্যে মাটি কাটাকাটি করে একেবারে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। পার্কের টয়লেট টি নোংরা, রং করা হলেও সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। টয়লেটে বৈদ্যুতিক মটর চলেনা বিল না দেওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মিটার তুলে নিয়েগেছে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস। টিউবয়েল প্রায়ই নষ্ট থাকে, পিকনিকের যে রান্না করবে সেই জায়গাটি একেবারে বাজে অবস্থা রান্না করার উপযোগী নেই, তবে এসব সংস্কারের জন্য মোটা অংকের টাকা বরাদ্দ করা হলেও শুনছি জুন মাসেই টাকা আত্মসাৎ করে ফেলেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
ভাটপাড়া ইকো পার্কের ইজারাদার আসমাউল হুসনা জানান, ভাটপাড়া ডিসি ইকো পার্কে পর্যটকদের জন্য মাত্রা আনার লক্ষ্যে এখানে ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। যে প্রকল্প গুলো বাস্তবায়ন হলে আমাদের পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসন ও লাভবান হবে এবং সম্মান বাড়বে ডিসি ইকো পার্কের। কিন্তু এই ছয়টি প্রকল্পের কাজ না করেই বিল উত্তোলন হয়ে গেছে। অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে আমাদেরেঐতিহাসিক ভাটপাড়া ডিসি ইকো পার্ক। তবে বিল উত্তোলনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর লোক দেখানোর জন্য নামমাত্র কিছু কাজ এখন করছে পিআইও অফিস। বাইরে থেকে মাটি এনে ভরাট করার কথা থাকলেও ব্রিটিশদের নিদর্শন যুক্ত সেই সব মাটিগুলোই ভাটপাড়া ইকো পার্কের ভিতরে কেটে গর্তের সৃষ্টি করে লোকজন চলাচলে বাধাগ্রস্ত করছে এই পিআইও অফিস। মাটি কাটার সাথে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ মাটি বাইরে থেকে না এনে এই মাটি কেন ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অফিস সূত্র জানিয়েছে, এই ৬ প্রকল্পের কাজ করতে চলতি বছরের ১৩ মার্চ ও ২৮ এপ্রিল এবং ১৯ জুন বরাদ্দের মোট ২৮ লাখ ৪৮ হাজার ২৭৮ টাকা বিল উত্তোলন করেছেন। তবে এই টাকার মধ্যে ১ লাখ ৯৯ হাজার ১৩৯ টাকা পে-অর্ডার দেখনো আছে। পিআইসিদের স্বাক্ষর নেওয়ার পর গত ২২শে জুন প্রকল্পের সমস্ত অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। ডিসি ইকো পার্কের কাজে পিআইসি (প্রকল্প কমিটি) সভাপতি করা হয়েছে সাহারবাটি ইউনিয়ন পরিষদের (সংরক্ষিত) আসনের সদস্য জরিমন নেছা ও ফেরদৌসী আক্তারকে।
পিআইসি (প্রকল্প কমিটি) সভাপতি ও ইউপি সদস্য জরিমন নেছা বলেন, আমাকে কিছু কাগজপত্র স্বাক্ষর করতে বলেন পিআইও স্যার। আমি স্বাক্ষর করে দিই। আমাকে পাঁচ হাজার টাকাও দেওয়া হয়। পরে আমাকে আরও কিছু টাকা দেবে বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু পরে আমি জানতে পারলাম যে আমি ভাটপাড়ার কয়েকটি কাজের পিআইসি। যে কাজগুলো করাই হয়নি। এখন করা হচ্ছে আমি দেখছি তবে এই কাজগুলো পিআইও অফিস করছে। মিস্ত্রিরাও বলেছে পিআইও অফিসের স্টাফরা তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে।
আরেকজন পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সভাপতি ও ইউপি সদস্য ফেরদৌসী আক্তার বলেন, নামে মাত্র আমাকে কাজের পিআইসি করা হয়েছে, কিন্তু কাজ করছে পিআইও অফিস। কাজের কিছুই আমি প্রথমে জানতাম না। আমাকে বলছে যে একটি বিল উঠবে আপনাদের কিছু স্বাক্ষর লাগবে স্বাক্ষর করেন। আমি স্বাক্ষর করার পরে জানতে পারলাম যে জুন মাসে আমাদের ভাটপাড়া ইকো পার্কে কিছু কাজ হয়েছে, সে কাজের পুরো বিল তোলা হয়েগেছে। তারা টাকা তুলে নিজেরা কাজ করবে করুক কিন্তু আমাদেরকে প্রকল্পেরে সভাপতি বানানোর কি দরকার। তবে যেহেতু আমাদের এই কাজে সভাপতি বানিয়েছে তাহলে আমাদের উপর কোন দোষ চাপালে পিআইওকে ছাড়বো না। পিআই ও তো আমার কেউ হয় না। পিআইও স্যারকে বার বার কাজের এ্যাস্টিমেট দিতে বলার পরেও তিনি তা দেননি। টাকা খাবে পিআইও আর আমরা কেনো সাংবাদিকদের সামনে আমাদের দোষি করবে কেনা?। শুরু থেকে কাজ করা হয়নি। টাকা হজম করতে না পেরে এখন তোড়জোড় করে নামমাত্র কোনরকম কাজ করছে।
সাহারবাটি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আসমাতারা বলেন, এই কাজটি সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। তবে শুনেছি প্রকল্পের বিল তুলে মেম্বারদের হাতে ৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েই বিদায় করেছেন। বলেছে আপনাকে কিছু করতে হবে না, যা করার তা আমরা করছি।
এবিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মনসুর রহমানের বক্তব্য নিতে গেলেই জানা যায় তিনি অফিসে আসেননি। এভাবেই সাংবাদিকদের সাথে চলতে থাকে লুকোচুরি খেলা। বার বার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি তা রিসিভ কেরেন না। তিনি শুধুমাত্র আস্থাভাজন কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলেন। বৃহষ্পতিবার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে আসলে কয়েকজন সাংবাদিকের সামনে পড়েন তিনি। শটকে পড়ার চেষ্টা করলেও পরিশেষে তিনি বলেন এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আপনারা লিখে দেন আমি এ বিষয়ে বক্তব্য দেব না।
গাংনী উপজেলা পরিষদ সোনালী ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক বজলুল হুদা জানান, পিআইও অফিস থেকে প্রকল্পের কাগজ তৈরি করে। উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে অনুমোদন হলে আমাদেরকে বিল পাঠায় পিআইও অফিস। সেই বিলে তারা কখনো একাউন্টস পে অথবা নগদায়ন করে দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা অ্যাকাউন্টস পে হলে পিআইসির একাউন্টে দিয়ে দেয়। অন্যথায় নগদ প্রদান করা হয়।
উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জাহিদ আলম জানান, আমরা প্রত্যেকটা বিলের পিছনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অথবা পিআইসির অ্যাকাউন্ট নম্বর লিখে দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট পিআইসিদের অ্যাকাউন্টেই আমাদের টাকা পাঠানোর কথা এবং সেই একাউন্ট গুলোই আমরা স্বচ্ছ ভাবে লিখে দেয়। একাউন্টসের বাহিরে টাকা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। ফলে প্রত্যেকটি বিলই ওই সংশ্লিষ্ট একাউন্টগুলোতে যাওয়ার কথা।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শেষ সময়ে হলেও প্রকল্পগুলোর কাজ যেহেতু চলছে। সকল প্রকল্প সঠিক বাস্তবায়ন না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।