কবি তাঁর দেবদূত প্রতিম অভিভাবক কাদম্বরী দেবীকে হারান। কাদম্বরী ছিলেন কবির বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-এর স্ত্রী। ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর কাদম্বরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (আসলে আত্মহত্যা)। কিছুদিন আগে কবি তাঁর বড় ভাই (কাদম্বরীর স্বামী) এবং তাঁদের অনুপ্রেরণাদানকারী পিতা উভয়েই নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এটি ছিল কবির জীবনের সবচেয়ে ক্লান্তিকর সময়। কবির বিয়ে হয় ১৮৮৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর। মৃণালিনীর বয়স তখন নয় বছর। বিয়ের দশ বছরের মধ্যেই কবির পাঁচ সন্তান জন্ম লাভ করে। মৃণালিনীর বিয়ে হয় অল্প বয়সে। মৃণালিনীও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় কবি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। এই আঘাতের সাথে যোগ হয় মৃণালিনীর অসুস্থতা। ১৯০২ সালে চিকিৎসার জন্য কবিপত্নীকে শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকোতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর রোগ নির্ণয় করতে সফল হননি। ফলে ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃণালিনীর মৃত্যু হয়। কবিপত্নীর মৃত্যু কবিকে বিধ্বস্ত করে তোলে। কবির হৃদয় ভেঙে যায়। তারপরও কবির একান্ত কাছের মানুষগুলোর মৃত্যুর অনুভূতি নিয়ে কবি অনেক কবিতা লেখেন। হৃদয় নিঙড়ানো এই অনুভূতি কবি তাঁর কবিতার মধ্যে ঢেলে দেন। মৃণালিনী যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স বিশের কোঠায়। কবির বড় মেয়ে মাধুরীলতা যার ডাক নাম বেলা—বিয়ের এক মাসের মধ্যেই কবিপত্নীর মৃত্যু হয়।
মৃণালিনী তিন মেয়ে ও দুই ছেলে রেখে যান। বড় ছেলের বয়স পনেরো এবং ছোট ছেলের বয়স সাত। এখন বেলা ছাড়া বাকি সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব কবির উপর বর্তায়। স্ত্রীর সাথে ছিল কবির মধুর প্রেমময় সম্পর্ক। মৃণালিনী কবির প্রতি এতটাই তীব্র ছিলেন যে, কবির জন্য বাংলার পাশাপাশি তিনি ইংরেজি ও সংস্কৃতও শেখেন। কবিপত্নী সংস্কৃত ও রামায়ণ বাংলায় তরজমা করেন। বিনিময়ে তিনি কবির নিকট থেকে অবর্ণনীয় উষ্ণতা পান। মৃণালিনীর মৃত্যু সংবেদনশীল কবির কাছে জীবনের রহস্য উন্মোচন করে। এই সময় কবির অনেক আপনজনের মৃত্যু ঘটে। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পর কবির দ্বিতীয় কন্যা রেণুকা গুরুতর (গ্রেভলি ইল) অসুস্থ হয়ে পড়ে। রেণুকার যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে, যা সেই সময় নিরাময়যোগ্য ছিল না। কবি রেণুকার (রাণী) জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু রেণুকা ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, মায়ের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে মারা যান। রেণুকা ছিল খুবই প্রাণবন্ত ও চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। অল্প বয়সে রেণুকার বিয়ে হয়। কবির কষ্ট (ডিস্ট্রেস) তখনও শেষ হয়নি। ১৯০৭ সালে কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ বন্ধুর সাথে মুঙ্গেরে (মধ্যপ্রদেশ) বেড়াতে যান এবং সেখানে কলেরা রোগে আক্রান্ত হন। শমীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেরো। কবি পুত্রের কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পেয়ে তৎক্ষণাৎ কলকাতা থেকে মুঙ্গেরে রওনা দেন। কাকতালীয়ভাবে (কিনসিডেন্টালি) পাঁচ বছর আগে যখন তাঁর মা মারা যান, ঠিক সেই তারিখেই শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুকে স্মরণ করে কবি একটি কবিতা লেখেন। কথায় বলে, দুর্ভোগ কখনো একা আসে না—আসে সংঘবদ্ধভাবে। এক দশক পর কবির বড় মেয়ে মাধুরীলতা (বেলা) (১৮৮৬-১৯১৮) যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয় এবং ১৯১৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। মাধুরীলতার স্বামীর সাথে কবির সম্পর্ক ভালো ছিল না। কবির সবচেয়ে কনিষ্ঠ কন্যা মীরা (আতসী) (১৮৯৪-১৯৬৯)-র তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়। তাঁর ছিল দুটি সন্তান। মীরার মৃত্যু হয় ১৯৬৯ সালে। কবি বুঝতে পারেন যে, তাঁর একান্ত আপনজনেরা সব অকালে মৃত্যুবরণ করছে। কবি তাঁদেরকে পলাতক (ফিউজিটিভ) বলে অভিহিত করেন। ইতোমধ্যে মাধুরীলতার মৃত্যু হয়। কবির “পলাতক” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মাধুরী, রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে এই কবিতাগুলো লেখা হয়।
লেখক
জাহিদ হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা