কলকাতা থেকে একশত মাইল উত্তরে অবস্থিত শান্তিনিকেতন। বর্তমান এটাকে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শহর। গোড়াতে এটি রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্মিত একটি আশ্রম ছিল। সেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ এখানে এসে পরমেশ্বরের ধ্যানে সময় কাটাতেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি মহর্ষি[সাধু এবং ঋষি নামে খ্যাত ও পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতীয় নবজাগরণের একজন স্বনাম খ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। শান্তিনিকেতনের অপর নাম ছাতিম তলা। এই ছাতিম গাছের তলে ধ্যানকারীরা ধ্যান করার সময় আধ্যাত্মিক উপলব্ধি বা চেতনা লাভ করেন। এটি ছিল বীরভূম জেলার একটি শুষ্ক অঞ্চল। এই ছাতিম গাছ গুলো এখনও একটি স্মৃতি ফলকসহ দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে লেখা আছে:এই ছাতিমতলা আমার জীবনের বিশ্রাম। আমার হৃদয়ের আনন্দ। আমার আত্মার শান্তি। ছাতিমতলা নামে পরিচিতি এই স্থানটি শান্তিনিকেতনের মূল সূচনা বিন্দুর প্রতীক বলা যায়। যা পরবর্তীতে কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনের আশ্রয় গৃহ এবং কবির দার্শনিক ও বিশ্বজনীন সকল কাজের উৎস হয়ে ওঠে। এখন এই ছাতিম তলাকে একটি পবিত্র স্থান (হলোয়েড স্পট) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে নানাবিধ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথও তাঁর পিতার মতো সূর্যাস্তের সময় ছাতিম গাছের নিচে বসে ধ্যান করতেন। মহর্ষির নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে ছিল শান্তিনিকেতনে গৃহ। এখানে সুন্দর রঙিন কাঁচের মন্দির নির্মাণ করা হয়। যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কথিত ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত দুটি স্থাপনা শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা এবং বাংলা ও ভারতের ধর্মীয় আদর্শের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কিত সার্বজনীন চেতনার সাথে যুক্ত ছিল। শান্তিনিকেতনের এই বাড়ির চারদিকে একটি সুন্দর বাগান তৈরি করা হয়। [লেইড আউট]। এখানে প্রথম শুকনা মাটির উপরের স্তরটি সরিয়ে বাইরে থেকে আনা উর্বর মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। ছায়ার জন্য লম্বা পাতাযুক্ত বিভিন্ন গাছের সারি রোপন করা হয়। বিভিন্ন ফলের গাছও রোপন করা হয়। শাল গাছের এই পথ যা কবির প্রিয় পদচারণার জন্য তৈরি করা হয়-আশ্রমবাসীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ ছেড়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং সেখানে আরেকটি আশ্রম নিজ উদ্যোগে তৈরি করেন। সেখানে তিনি একটি মার্বেল খচিত প্রার্থনা কক্ষ [মন্দির],একটি পরীক্ষমূলক স্কুল, বৃক্ষ শোভিত একটি বাগান এবং একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন। ১৯০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতনের এই স্কুলটি উদ্বোধন করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি এখানকার পড়াশোনার পরিধি সম্প্রসারিত করেন। যা ধীরে ধীরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। [নিউক্লিয়াস অফ দ্য ইউনিভার্সিটি]। বিশ্ববিদ্যালয়টি উদীয়মান পশ্চিমা এবং ভারতীয় দর্শন এবং শিক্ষার জন্য নিবেদন করা হয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সেই ইচ্ছার প্রকাশ বা প্রতিফলন ছিল-যা তিনি জীবন ব্যাপী অর্জন করতে চেয়েছিলেন। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে কবিকে পাশ্চত্য চিন্তাভাবনা লালন করতে হয়।তাকে বিদেশে ভারতীয় চিন্তাভাবনার সমর্থন পেতে হয়। শান্তিনিকেতন পরে একটি পুর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় এবং নামকরণ করা হয় বিশ্বভারতী।
কবি যেখানে থাকতেন সেই উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স-এ বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে।যেমন উদয়ন,কোনার্ক,শ্যামলী,পুনশ্চ এবং উদীচী। এগুলো কবির প্রসিদ্ধ পুত্র[ইলাসট্রিয়াস সান] প্রয়াত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থাপত্য প্রতিভায় নির্মিত হয়।এছাড়াও সেখানে রয়েছে কলা ভবন,[ চারু ও কারু শিল্প কলেজ],সঙ্গীত ভবন[সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কলেজ], বিদ্যাভবন[মানবিক কলেজ],শিক্ষাভবন[বিজ্ঞান কলেজ],বিনয় ভবন[শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কলেজ],চীনা ও হিন্দি ভবন।বিশ্বভারতীর শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাসটি শিক্ষার কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে তোলা হয়। যেমন শিল্পকলা সঙ্গীত ও মানবিবক বিভাগ নিয়ে গড়ে ওঠে একটি পুর্ণাঙ্গ মানবিক বিভাগ। শ্রীনিকেতন মূলত পল্লী সেবা ও অধ্যয়ন কেন্দ্র[পল্লী সমিতি] বিভাগ-যেখানে একটি কৃষি কলেজ[পল্লী শিক্ষা সদন] রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর পরবর্তী সময়ে নির্মিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো হল নন্দলাল বসু এবং তাঁর ছাত্রদের দ্বারা নির্মিত সুন্দর রঞ্জক পর্দাথ দিয়ে তৈরি সুন্দর [ফ্লেস্কো] পাঠ ভবন, নূতন বাড়ি, যা ১৯০২ সালে কবি তাঁর পরিবারের জন্য তৈরি করেন।এই সাধারণ খড়ের তৈরি কূটিরটি ১৯১৫ সালে মহাত্মা গান্ধীর ফিনিক্স[পৌরাণিক পাখি-যে আরব্য মরুভূমিতে শত শত বছর বাঁচার পর চিতাগ্নিতে নিজেকে ধ্বংস করে সেই চিতাভস্ম থেকে পুনরায় বেঁচে ওঠে। যা নবজন্মলাভকারী প্রাণী বা বস্তু] স্কুলের ছেলেদের জন্য অর্পণ করা হয়।কবির স্ত্রী মৃণালিণী দেবী বাড়িটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যান। কিন্তু কবিপত্মী নাম ও তাঁর নামে নামকরণ করা নার্সারি স্কুলটিএখন টিকে আছে। মৃনালিণী আনন্দ পাঠশালা এখানে অবস্থিত।কবির দেহালি[চৌকাঠের উপর বা নিচের কাঠ দ্বারা নির্মিত ভবনের বারান্দা] ১৯০৪ সালে নির্মিত হয়। কবি কিছু সময়ের জন্য এখানে বসবাস করেন। সন্তোষচন্দ্র একটি একতলা ছাদযুক্ত বাড়ি শান্তিনিকেতনকে প্রদান করেন। এই বাড়িটি শান্তিনিকেতনের প্রথম ছাত্রদের একজন সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের নামে নামকরণ করা হয়। এই নামে ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়।
শান্তিনিকেতনে কাটানো দিনগুলোর সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আরও বেশি জ্ঞান অর্জনের জন্য বোম্বে পাঠানো হয়। কবিকে পড়ানোর জন্য সেখানে একজন মহিলা শিক্ষিকা নিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে একটি উষ্ণ ও স্নেহপূর্ণ[ওয়ার্ম অ্যান্ড অ্যাফেকশনেট] সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই শিক্ষক কবিকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন। কবি তার শিক্ষিকার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা লেখেন। কবি তার শিক্ষককে কবির কবিতা নলিণী থেকে একটি চরিত্রের নামও দেন।
চলবে…
লেখক
জাহিদ হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা