নিরব ঘাতক থাইরয়েড, বাংলাদেশের চিত্র ভয়াবহ

অনলাইন ডেস্ক

থাইরয়েড শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু ও অঙ্গের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে; বিপাকের হার, হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা, হজমের প্রক্রিয়া, পেশি ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তাই থাইরয়েডের সমস্যা হলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।

মানবদেহের গলার সামনের দিকে ছোট একটি প্রজাপতির মতো দেখতে গ্রন্থি থাইরয়েড অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে। এটি দেহের বিপাকক্রিয়া, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ এবং হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি নিয়ে মানুষের সচেতনতা এখনো হতাশাজনকভাবে কম।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটির বেশি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশেও চিত্রটি ভয়াবহ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডজনিত রোগে আক্রান্ত, কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই জানে না যে তারা এই রোগে ভুগছে। কারণ, এই রোগের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং রোগীরা তা সাধারণ ক্লান্তি বা ওজনবৃদ্ধির মতো হালকাভাবে নেয়।

বিশেষ করে নারীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। নবজাতকের মধ্যে জন্মগতভাবে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা জন্ম–পরবর্তী শিশুর বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়তে হলে গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা ও তা নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিশুর জন্মের পরপর থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।

থাইরয়েডজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো হাইপোথাইরয়েডিজম (যেখানে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হয়), হাইপারথাইরয়ডিজম (যেখানে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ হয়), গলগণ্ড বা গলার ফোলা, নডিউল এবং থাইরয়েড ক্যানসার। নডিউলগুলোর বেশির ভাগই নিরীহ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই নডিউল ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশে আয়োডিন ঘাটতির কারণে এই ঝুঁকির মাত্রা তুলনামূলক বেশি।

এত দিন পর্যন্ত এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অপারেশনই ছিল প্রধান চিকিৎসাপদ্ধতি। কিন্তু এতে থাকে জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। অপারেশনের ফলে গলায় স্থায়ী দাগ, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন, ক্যালসিয়াম ভারসাম্যহীনতা এবং আজীবন হরমোন ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া—এসবই রোগীর জীবনমানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

এ প্রেক্ষাপটে চিকিৎসাক্ষেত্রে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরএফএ) প্রযুক্তি যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি একেবারেই ন্যূনতম হস্তক্ষেপমূলক, আধুনিক ও নিরাপদ চিকিৎসাপদ্ধতি, যা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই শুধু আক্রান্ত টিস্যু ধ্বংস করে। আলট্রাসাউন্ডের সাহায্যে থাইরয়েড নডিউলের অবস্থান চিহ্নিত করে সুচের মাধ্যমে তাপশক্তি প্রয়োগ করে টিস্যুকে ধ্বংস করা হয়, কিন্তু থাইরয়েড গ্রন্থির অবশিষ্ট অংশ অক্ষত থাকে।

এ পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটি মাত্র ৩০–৪০ মিনিটেই সম্পন্ন হয় এবং রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় না। গলায় কোনো দাগ পড়ে না, অপারেশনের প্রয়োজন নেই এবং অধিকাংশ রোগী পরদিন থেকেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারেন। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা অক্ষত থাকায় আজীবন হরমোন সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

আজ বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশনের (ETA) উদ্যোগে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালন শুরু হয়। পরে এতে যুক্ত হয় আমেরিকান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশন (ATA), এশিয়া-ওশেনিয়া থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশন (AOTA) এবং ল্যাটিন আমেরিকান থাইরয়েড সোসাইটিও। বর্তমানে প্রতিবছর ২৫ মে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *