রোডম্যাপ চায় বিএনপি জামায়াত চায় সংস্কার

আজকের চুয়াডাঙ্গা ডেস্ক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করার কথা ভাবছেনÑ সম্প্রতি দেশজুড়ে এমন আলোচনার মধ্যে গতকাল শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তার সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। এ সময় প্রতিটি দল সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে তাদের অবস্থান তুলে ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় আজও হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদসহ ৮টি দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের কথা রয়েছে।

গতকালের বৈঠকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে বিএনপি। দুই ছাত্র-উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি করেছে দলটি। অন্যদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়েছে, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই সবকিছু স্বাভাবিক হবে বলে দলটি মনে করছে। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া হয়নি। এছাড়া জুলাই গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ, গণপরিষদ ও আইনসভার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে এনসিপি।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে বিএনপি। দলটি মনে করে, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন প্রয়োজন। তাদের ভাষ্য, জুলাই আন্দোলনের গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিচার ও রাষ্ট্রের সংস্কার বিএনপিও চায়। সংস্কার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এসব দ্রুত করা উচিত। দেশে যাতে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে লক্ষ্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া ও খলিলুর রহমানের পদত্যাগও দাবি করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। দলে আরও ছিলেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। রাত পৌনে ৮টায় বিএনপির প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরে বিএনপি। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র উত্তরণের লক্ষ্যে বিএনপি প্রথম থেকেই একটি সুস্পষ্ট জাতীয় নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বলেছি যে, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশে সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। এ জন্য আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি সবচেয়ে বেশি বিএনপির। এ বিচারপ্রক্রিয়া অসম্পন্ন থেকে গেলে বিএনপি সরকারের দায়িত্বে গেলে বিচারের আওতায় এনে তা স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে।

সংস্কারপ্রক্রিয়া চলমান জানিয়ে ড. মোশাররফ বলেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্কার কার্যক্রম অবিলম্বে সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুত একটি রোডম্যাপ প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র উত্তরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা। যে কোনো উসিলায় নির্বাচন আয়োজনে বিলম্ব করা হলে আবার স্বৈরাচার ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে বলে আমরা মনে করি। এ ক্ষেত্রে এর দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকার এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওপর বর্তাবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি কখনোই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি, বরঞ্চ প্রথম দিন থেকেই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়া চলবে। বিচারের কাজ বিচার বিভাগ করবে। সুতরাং, ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনÑ তিনটি বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। তিনটিই ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু। দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা হলে বাংলাদেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্র ফিরে আসবে।

প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের রোডম্যাপ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলেছেন কি? এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের দাবি জানিয়েছি। সরকার তার প্রেসের মাধ্যমে পরবর্তীতে জানাবে। তারপর আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া দেব। আমরা নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও দুইজন ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়ে লিখিতভাবে বলেছি, যাদের কারণে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই সবকিছু স্বাভাবিক হবে বলে মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করলেও জামায়াত কারও পদত্যাগ চায়নি। গতকাল শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা জানান জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক শেষে জামায়াতের আমির আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শুনেছেন। তিনি বলেন, দেশ আমাদের সবার। তিনি দেশে একটি সুন্দর নির্বাচন দেখতে চান। তিনি যেনতেন নির্বাচন দেখতে চান না। সব দলের কথা শুনে তিনি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে আমরা মনে করি।
রাত ৯টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন যমুনায় বৈঠকে বসেন জামায়াতের আমির। তার সঙ্গে ছিলেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জামায়াত আমির বলেন, আমরাই শুধু নয়, সবাই সংস্কারের পর নির্বাচন চায়। আমরা সময় বেঁধে দিইনি। সংস্কার শেষ হলে ফেব্রুয়ারির মধ্যে, তা না হলে রোজার পরপরই নির্বাচন হতে পারে।

ড. শফিকুর রহমান বলেন, সম্প্রতি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি প্রধান উপদেষ্টার জন্য কষ্টকর ছিল। আমরা মনে করি, দেশ আমাদের সবার। দেশ ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকব। তিনি বলেন, দেশের মানুষ সাড়ে ১৫ বছর ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন দিতে চায়। তবে সুনির্দিষ্টভাবে দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি। এটি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমাদেরও কিছু পরামর্শ ছিল। দেশের স্বার্থটা তিনি (ড. ইউনূস) দেখবেন বলে আমরা মনে করেছি।

জামায়াত আমির বলেন, আমরা বৈঠকে বলেছি, সময় (নির্বাচনের) দিয়েছেন সেই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। তার আগে সংস্কার ও বিচারের প্রক্রিয়া জনগণের সামনে আসতে হবে। যদিও সব সংস্কার এই সরকার করতে পারবে না। মাত্র পাঁচটি বিষয়ে তারা সংস্কারে হাত দিয়েছে। আমাদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার আছে, যেটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ঐক্যবদ্ধ সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি অর্থবহ নির্বাচন হবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।

এদিকে জুলাই গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ, গণপরিষদ ও আইনসভার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে এনসিপি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এসব কথা জানান। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ বৈঠক শুরু হয়।

বৈঠকে শেষে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছি, অন্তর্বর্তী সরকারে যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে আছেন, তারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে গেছেন। সরকারকে বৈধতা দিয়েছেন। তাদের সাথে রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। তাদের হেয় করা, অপমান করার নিন্দা জানিয়েছি। তাদের পদত্যাগ চাওয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবেনÑ এটা এনসিপির পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *