চুয়াডাঙ্গায় আধুনিকতার ছোয়ায় বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধানভাঙ্গা ঢেঁকি

আব্দুর রহমান অনিক, দর্শনা অফিস

যন্ত্রসভ্যতার দ্রুত অগ্রগতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক চিরচেনা অংশ ঢেঁকি। একসময় প্রতিটি গ্রামে ধান ভানার প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন এটি শুধুই স্মৃতির পাতায়। নবান্ন থেকে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার সবকিছুর সঙ্গে জড়ানো ছিল ঢেঁকি। কিন্তু সময়ের স্রোত, মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির দাপটে আজ ঢেঁকি খুঁজে পাওয়া যেন দায়।

চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তঘেঁষা দর্শনা থানার অন্তর্গত  গ্রামাঞ্চল ঘুরে দেখা যায় পুরনো খোপের ঘরে ছাউনি পড়া, মাটিতে পড়ে থাকা, কিংবা মাটির নিচে অর্ধেক ডুবে থাকা ভাঙা ঢেঁকি যা এখন শুধুই অতীতের স্মারক। দর্শনার আজমপুর  মহল্লার ৭০ বছর বয়সী সয়েরা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, তার স্মৃতিতে এখনো ভেসে ওঠে ঢেঁকির আওয়াজ। আমরা ছোট থাকতে মা-খালা মিলে ভোরে উঠে ঢেঁকিতে ধান ভানতাম। সেই শব্দে গ্রামের সকাল শুরু হতো। এখন তো মেশিনের শব্দে মানুষ নিজের কথা পর্যন্ত শোনে না। ঢেঁকি চালাইনি বহু বছর। তার আক্ষেপ, নতুন প্রজন্ম ঢেঁকির নাম জানে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখেনি। সেই সঙ্গে ঢেঁকি চালাতে যে দক্ষতা, ছন্দ ও কৌশল লাগত তাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

স্থানীয় কৃষক নাসিরসহ কয়েক ব্যক্তি জানান, ঢেঁকি প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পেছনে কিছু  কারণ দেখেন। আধুনিক রাইস মিল, কল-কারখানা, ধান ভাংগার মেশিন ঢেঁকিকে অপ্রয়োজনীয় করে দিয়েছে। ভালো মানের কাঠ পাওয়া কঠিন হওয়ায় ঢেঁকি তৈরি করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ঢেঁকি চালানো কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় গৃহিণীরা স্বাভাবিকভাবে সহজ প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকেছেন। ঢেঁকিতে ভানা চালের স্বাদ আলাদা ছিল। ভাত ছিল ঝরঝরে, পিঠার গন্ধ ছিল অন্যরকম। মেশিনের চাল সেই স্বাদ দেয় না। ঢেঁকিতে ভানার সময় চালের বাইরের পুষ্টিকর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ফলে ঢেঁকির চাল ছিল বেশি স্বাস্থ্যকর। ঢেঁকিতে ভানার সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেক সামাজিক রীতি নবান্ন উৎসব, গৃহস্থালির আড্ডা, বৌ-ঝিদের গান। ঢেঁকির ছন্দে মিলেমিশে যেত পারিবারিক উষ্ণতা।

মানুষের পরিশ্রম, গ্রামের ঐতিহ্য, নারীর অবদান, পারিবারিক বন্ধন সবকিছুর প্রতীক ছিল ঢেঁকি। কালের বিবর্তনে আজ এটি বিলুপ্তির পথে। কিন্তু যারা ইতিহাসে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে ঢেঁকি এখনো এক জীবন্ত সাক্ষী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *