সংগ্রাম থেকে সফলতার শিখরে আলমডাঙ্গার নারী উদ্যোক্তা নাহিদা খাতুন

খন্দকার শাহ আলম মন্টু, আলমডাঙ্গা
নারীর উদ্যোক্তার সফলতার কাহিনীগুলো অধ্যবসায়, সৃজনশীলতা এবং প্রতিকূলতা জয়ের গল্প, যেখানে ঘরোয়া কাজ বা শখকে পেশায় রূপান্তরিত করেছে নারী উদ্যোক্তা মোছাঃ নাহিদা খাতুন, জন্ম ১২ ই আগস্ট ১৯৯৪  সালের আলমডাঙ্গা উপজেলার গাংনী ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম রামনগরে, মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে, বাবা ছিলেন একজন ছোট্ট ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী, চার ভাই বোনের মধ্যে বাবা- মায়ের প্রথম সন্তান। জীবনের নানা অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা। কিন্তু তারপরও সুখের কোন অভাব ছিল না।
প্রাথমিক স্কুল জীবন, প্রাথমিক স্কুল জীবনটা শুরু হয়েছিল বাবার হাত ধরেই যেমন তার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানাবে, সেই সূত্রে গ্রাম থেকে ৩কিলোমিটার দূরে বাজারে একটি প্রাইভেট স্কুল ছিল সেখানে ভর্তি হয়েছিল নাহিদা খাতুন।
জীবনটা শুরু হয় ২০০৫ সালে আসমান খালি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভর্তি হয়ে ২০১০ সালে সফলতার সাথে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। বাবা কলেজে ভর্তি করবে কিন্তু গ্রামের মানুষ অনেক বলত মেয়েকে এত পড়িয়ে লাভ কি বিয়ে দিয়ে দিতে, কিন্তু নাহিদার বাবার একটাই কথা মেয়েকে পড়াশোনা করাবে, ডাক্তার বানাবে এবং তিনি ভর্তি করে দেন কলেজে ভর্তি করিয়ে ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি  মহিলা  কলেজে। এটা যেন তার বাবার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছিল গ্রাম থেকে একটা মেয়ের পড়াশোনা করানো, বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হতো নাহিদার বাবাকে কিন্তু সে এক কথার মানুষ।
কলেজে ভর্তি হয়ে টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা খরচ চালানোর জন্য বাবাকে কোনরকম প্রেসার দিতনা, সে টিউশনি টাকা দিয়ে কোনরকমে টেনেটুনে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রী কমপ্লিট করে।
এরপরে পড়াশোনা চলাকালিন সময় এর মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় নাহিদার। স্বামী পরিবারের অমতে পছন্দ করে বিয়ে করেন, আর এটাই জীবননের কাল, হাজব্যান্ড একজন প্রবাসী ছিলেন হঠাৎ এক ফিঙ্গার ইনজুরিন এর জন্য তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়, আর এটাই হয় তার জীবনের সবথেকে বড় ব্যর্থতা, সে মরে যাবে তাও তাকে প্রবাসে থাকতে হবে কারণ প্রবাসীরা তো  টাকার মেশিন, এটা নিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে অনেক ঝামেলা শুরু হয়ে যায় তাও সে দেশে চলে আসে। নাহিদার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় ১৪ ই নভেম্বর ২০১৭ সালে, তখন সে বাবার বাড়িতেই থাকতো। স্বামী দেশে আসার পর সেও শ্বশুরবাড়িতেই চলে যায়।
তার স্বামী প্রবাস থেকে আসার পরে ছোট্ট একটা গার্মেন্টসের দোকান দেয়, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি ভাগাভাগিতে দোকানটা ভেঙে দেওয়া হয়। স্বামী ভীষণভাবে বেকার হয়ে পড়ে এবং স্বামীর বেকারত্ব দেখে নাহিদা ভীষণভাবে ভাবায় সাথে ছোট্ট একটা অবুঝ শিশু, আমরা যেন একটা মস্ত বড় বোঝা হয়ে যায় পরিবারের কাছে, সে কলেজে পড়াকালীন সময়  চুয়াডাঙ্গা যুব উন্নয়ন থেকে সেলাইয়ের কাজ শিখে এবং ওয়েব ফাউন্ডেশন থেকে বিভিন্ন কাজ শেকে, আর এই কাজগুলো চরম দুর্দিনে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে ২০১৯ সালের  শেষের দিকে যাত্রা শুরু হয়, আগে থেকে মেশিন ছিল। স্বামীর অনুমতি নিয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করে, কিন্তু সে প্রথমে রাজি হয়নি। প্রতিবেশীদের একটা দুইটা সেলাই কাজ করতে করতে ভীষণ সাড়া পায় সবাই তার হাতের কাজ সবাই খুব পছন্দ করত এভাবে আস্তে আস্তে সংসার খরচ নিজের খরচ চালিয়ে ১৪ হাজার টাকা পুজি হয়েছিল, আর সেই পুঁজি থেকে নরসিংদী থেকে রিজেক্ট কাপড় নিয়ে এসে ব্যবসা শুরু করে, সে এত পরিমাণ মানুষের সাড়া পাই হাতের সুন্দর কারুকাজ দিয়ে, ঠিক সেই সময়ে ২০২০ সালে করোনার ভয়াল থাবা যেন পৃথিবীকে গ্রাস করতে আসে, ঠিক সেই সময় যখন বাজারের দোকান গুলো বন্ধ তখন তার দোকানে প্রচুর বেচা বিক্রি হত দোকানটা বাসার মধ্যেই ছিল, কিন্তু এটা যেন শ্বশুরবাড়ির কারো সহ্য হলো না, তার শ্বশুর ছিলেন যৌথ পরিবার সবাই একসাথে থাকতো, এত জনপ্রিয়তায় বেচা বিক্রি লোকজনের আসা-যাওয়া এগুলো দেখে খুব রাগারাগি করতো শ্বশুর বাড়ির লোকজন এবং এক সময় শশুর বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বললে, এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলো এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটা ভাড়া বাসায় উঠে করোনার মধ্যে, আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। করোনার সময় যখন স্কুল কলেজ গুলো বন্ধ ছিল সে সময় স্কুল কলেজের মেয়েদেরকে নিয়ে বিভিন্ন হাতের কাজ করাতো বেতন সিস্টেম এ এবং ছোট্ট পরিসরে ওদেরকে কাজের প্রথমে একটা ট্রেনিং দিয়ে যে কাজগুলো কিভাবে করতে হবে, তারপর একটা মেশিন থেকে পাঁচটা মেশিন ক্রয় করে এবং বিভিন্ন অসহায় মানুষকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে কাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে, এছাড়াও দুইটা অসহায় পরিবারের মেয়েকে নিজ দায়িত্বে নিজ খরচে  বিয়ে দায়, দেশ স্বাভাবিক হওয়ার পর জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন থেকে সেই সময় দেড় লক্ষ টাকার লোন নিয়ে  মুন্সিগঞ্জ বাজারে ছোট্ট একটা দোকান দেয়, তারপর আরেকটা সেখানে দুইটা দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। একদিকে টেইলার্সের কাজ একদিকে কসমেটিক্স প্রোডাক্ট একদিকে জুতা স্যান্ডেল, দুইটা দোকান মিলে তিন রকম আইটেমের পণ্য সেল করতো, এলাকার মানুষের অনেক কটু কথা শুনেছে। মেয়ে মানুষ হয়ে বাজারে দোকানদারি করো তোমার লজ্জা করে না কোন মান সম্মান নেই ইত্যাদি ইত্যাদি, আবার অনেকের ভালোবাসা দোয়াও পেয়েছি, তারপর আলমডাঙ্গা উপজেলাতে মেন মার্কেটে তিনটা দোকান নিয়েছে নাহিদা কসমেটিক্স কর্ণার, নাহিদা লেডিস পয়েন্ট ও নাহিদা লেডিস টেইলার্স। সকলের দোয়া ও ভালোবাসাতে তার ৩টা প্রতিষ্ঠান চলছে, অনেক অনেক মানুষের দোয়া ভালোবাসা পাচ্ছে। মুন্সিগঞ্জ মানবতা ফেরিওয়ালা টিমের পক্ষ থেকে, এছাড়াও বিভিন্ন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এযাবত পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন নারী কে একদম বিনামূল্যে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারা এখন সবাই এখন সাবলিল এবং বন্যার সময় বন্যার্থীদের জন্য দেড় লক্ষ টাকা ত্রান তহবিল তুলে দিয়েছে।
এছাড়াও তার প্রতিষ্ঠানে ৩জন কর্মরত আছেন এবং সেলাই কাজ এ ২ জন নিয়োযিত আছেন, এছাড়া ও বিভিন্ন স্বামী প্রিন্ট, নকশীকাঁথা ও তৈরি করার জন্য মেয়েরা নিয়োজিত গ্রামে গ্রামে, সবগুলো নাহিদার তত্ত্বাবধানে। এছাড়াও হোমমেড কেক নিয়েও কাজ করে এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আলমডাঙ্গা শাখা এর উদ্যোক্তা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে কাজ করছে এবং বিভিন্ন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি নিজের বাবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছোট ভাই বোনদের পাশে দাঁড়িয়েছে, হারিয়ে যাওয়া ভাইটাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। শশুর শাশুড়ি এখন নাহিদাকে অনেক ভালবাসে। বর্তমান মাসিক সেল ১০ লক্ষ এবং বর্তমান পুঁজি সব কিছু মিলিয়ে ৫০ লক্ষ প্লাস। নারী উদ্যোক্তা নাহিদা খাতুনের প্রাপ্তি এ যাগত পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে এর মধ্যে সফল আত্মকর্মী হিসেবে, মানবঅধিকারের বিশেষ অবদান রাখায় ও অদ্বিতীয়া নারী উদ্যোক্তা অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেয়েছে। বিসিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ট্রেনিং করে অনেক সার্টিফিকেট পেয়েছে এছাড়াও বিউটিফিকেশন এর বিভিন্ন কোর্স কমপ্লিট করেছে এবং বাংলাদেশে জনপ্রিয় ঢালিউড কুইন অপু বিশ্বাসের হাত থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করলে নাহিদা খাতুন বলেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি অনেক বড় সেটা যেন একদিন ভাঙতে ভাঙতে এক টুকরো হলেও থাকে আবার সেই এক টুকরা থেকে শুরু করতে পারি, কারণ আমি নারী আমিই পারি, আমার  স্বপ্ন আছে আলমডাঙ্গাতে একটা কারখানা দিব সেখানে শত শত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, জেলা উপজেলায় আউটলেট হবে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে, মুক্তি পাবে কিছু  মানুষ সোনালী সুন্দর প্রতিটি  দিন হবে, প্রতিটা মানুষের এ পরিকল্পনা এ সফলতা শুধু আমার একার নয় পুরো পৃথিবীর, আমি পৃথিবীকে জানাতে চাই আমি একজন মেয়ে হয়ে অনেক কিছু করতে পারি, মেয়ে হয়েছিলাম বলে বাবা কোনদিন অবহেলা করেনি, এখন বাবাকে বলতে পারি গর্বের সাথে তোমার ডাক্তার নাহিদা এখন অনেক বড় বিজনেসওম্যান হয়েছে, এ যাবত  পর্যন্ত বেশ কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। তবে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি প্রতিটা নারীর নিজের একটা পরিচয় থাকা দরকার আছে নিজে কিছু করার দরকার আছে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কারণ সব দায়িত্ব পুরুষের উপর বর্তায় না আমরাও নারী আমরাও পারি যে রাধে সে চুলও বাধে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *