বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫ -অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান

স্টাফ রিপোর্টার

“ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর”-কথাটি যেমন সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে, তেমনি সকলেই আমরা এর অর্থটি বুঝি; কিন্তু ক’জন ধূমপায়ী ধূমপান থেকে বিরত থাকি? ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে আমাদের কম বেশী জানা থাকলেও সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে হলে ধূমপান থেকে বিরত থাকতেই এবং জনগণকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। জনগণকে সচেতন ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এ বদাভ্যাস থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ দিবসটিতে ধূমপায়ীদের উদ্দেশ্যে তামাক এবং ধূমপানের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়।

আমাদের জানা ছিল ধূমপানের কারণে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগ হয়ে থাকে। এছাড়াও ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপের কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। কিন্তু সম্প্রতি বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপানের কারণে শুধু দৃষ্টিশক্তিই নয়, সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিষ্কের শেখার ক্ষমতাও  হ্রাস পায়। অর্থাৎ ধূমপানের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানসিক শক্তি।  

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, প্রতিটি সিগারেটে একজনের জীবন থেকে গড়ে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট করে আয়ু কেড়ে নেয়। একজন ধূমপায়ী একজন অধূমপায়ীর চেয়ে দশ বছর আগে মারা যায়। তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে শারিরীক কার্যকারিতা হারায় দশ বছর আগেই। মোটকথা ধূমপানের ফলে একজন মানুষ তার জীবন থেকে কমপক্ষে বিশ বছর হারায়। 

বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী তামাক বা মাদকজাতীয় দ্রব্যাদি সেবনে মারা গেছে প্রায় ১০ কোটি লোক। প্রতি বছর শুধু ধূমপানের ফলে প্রাণ হারায় প্রায় ৫০ লাখ লোক। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ ও ২০৩০ সালে এ সংখ্যা দাড়াবে যথাক্রমে ৬৫ লাখ ও ৮৩ লাখ। যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে নিম্ন থেকে মধ্য আয়ভূক্ত দেশগুলোর ওপর। যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে এ মৃত্যু ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবী প্রায় এক পঞ্চমাংশ লোক মারা যাবে শুধু ধুমপানের মত মরণ বিষে। আরো জানা গেছে প্রতি পাঁচজন ধুমপায়ীর মধ্যে একজন ধুমপায়ীর বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তাছাড়া ৮০ হাজার থেকে এক লাখ অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে প্রতিদিন ধুমপান শুরু করে, যার প্রায় অর্ধেক ঘটে এশিয়ায়। বিশ্ব সংস্থার মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ১৩০ কোটি লোক ধূমপানে আসক্ত এবং প্রতি সাড়ে ৬ সেকেন্ডে একজন ধূমপায়ী মারা যায়। উন্নত বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও আমাদের এ উপমহাদেশে এর সংখ্যা তেমন কমেনি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ধূমপানজনিত রোগের কারণে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৯ লাখ লোক। পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাটের এক জরিপ অনুযায়ী শুধু বিড়ি সেবনে মারা যায় পাঁচ লাখ লোক। বাংলাদেশে এ সংখ্যা প্রায় এক লাখ। চীনে প্রতি বছর ধূমপানের কারণে মারা যায় ১২ লাখ লোক, রাশিয়ায় ৪-৫ লাখ, আমেরিকায় সাড়ে চার লাখ, জার্মানিতে ১ লাখ ৪০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ২ লাখ, ইংল্যান্ডে ৯০ হাজার এবং অষ্ট্রেলিয়ায় ১৫ হাজার। মনে রাখবেন, ধূমপান শুরু করা যতটা সহজ, ত্যাগ করা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী কঠিন। কারণ, এটা এক ধরনের নেশা। মধ্য বয়সী ধূমপায়ীরা যদি জেনেশুনেও তা ছাড়তে না পারে, সেখানে কৌতুহলী স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়ে কীভাবে ছাড়বে? ধূমপান বা তামাকজাতদ্রব্যের সেবনের কুফল সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টিই একমাত্র পথ। 

জানা গেছে, প্রতিটি সিগারেটে রয়েছে কমপক্ষে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ৪৩টি উপাদান। ধূমপানের কারণে শতকরা ৮৭ জন লোক শুধু ফুসফুস ও ক্যান্সারে ভোগেন। এছাড়া ধূমপানের কারণে অন্য ৩টি প্রধান রোগ হল ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট ও উচ্চরক্তচাপ। করনারি হার্ট ডিজিজের মূলেও রয়েছে ধূমপান। এমনকি স্ট্রোক হয়ে শরীরে যে কোন অঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ে ধূমপানের কারণে। এমনকি ধূমপানের কারণে দেহে কোন ক্ষত শুকাতে দেরী হয়। পেটের ব্যথা, গলাব্যথা, প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস ঘটে। ত্বকের ভাজপড়া ও শুকিয়ে যাওয়া এটিও ধূমপানের কারণে হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় ধূমপায়ী মহিলাদের ভ্রণ তৈরী বা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি একবার ঘটলে বার বার ঘটার ঝুকি থেকেই যায়। দিনে ১০টি সিগারেটপায়ী মহিলাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ ভ্রণ নষ্ট হবার ঝুকি অন্যদের চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ বেশি। ধূমপায়ী মহিলারা বন্ধ্যাত্ব, রজঃশ্রাবজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন। ধূমপায়ী মহিলাদের মৃত্যুর হারও বেশি। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশী প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা ধূমপানজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ধূমপায়ী মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রসব হবে, বা গর্ভপাত হবে বা মৃত শিশু প্রসব হবে। এমনকি শিশুর মানসিক উৎকর্ষতা লোপ পাবে। ধূমপায়ী পুরুষের ক্ষেত্রে পুং হরমোন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা হ্রাস পায়। ধূমপায়ী পুরুষ-নারী উভয়ের বার্ধক্য দ্রুততর হয়। 

মনে রাখবেন বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা, গুল, দুকতা, চুরোট ইত্যাদি তামাক জাতীয় দ্রব্যে রয়েছে নিকোটিন (ঘরপড়ঃরহব)। এই নিকোটিনের মূল উৎস হল তামাক, যার বৈজ্ঞানিক নাম ঘরপড়ঃরধহধ ঃধনধপঁস খ কথায় আছে “নেশা তামাকেই শুরু এবং তামাকই নেশার গুরু” সেই তামাক দেশে-বিদেশে ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে। সেই জন্য তামাক চাষ হ্রাস না করে ধূমপান বন্ধ বা ধূমপান আইন কোনভাবেই বাসবতবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাই তামাক উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সমাজের লোকজনকে তামাকের অপকারিতা এবং কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে। ধূমপান বিরোধী আইনগুলোকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, দুটি সিগারেটে যে পরিমাণ নিকোটিন আছে, তা যদি ইনজেকশনের মাধ্যমে কোন সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে তার মৃত্যু অনিবার্য। আরো জানা যায়, যদি কোন ব্যক্তি সারাটা জীবন নিকোটিন সেবন করে তবে তাকে সাপে কামড় দিলেও নাকি লোকটি মরে না, সাপটি মরে যায়। বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা বলেছেন, পৃথিবীর এত ধুলা, ধোয়া ও গ্যাস যদি মানুষের ফুসফুসে না ঢুকতো তাহলে মানুষ হাজার হাজার বছর সুস্থ অবস্থায় জীবিত থাকতো। এছাড়াও ধূমপান বিষপান অপেক্ষা মারাত্মক এ কারণে যে, বিষপানে শুধু যে পান করে সেই মরে, কিন্তু ধূমপানে সে নিজেও মরে এবং চারপাশের অধূমপায়ীদেরও মারে। কোন কোন পরিবারে একজন ধূমপায়ী হলে, পরোক্ষভাবে পরিবারের সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতেও সকল প্রকার নেশা জাতীয় বস্তু হারাম। সেদিক থকে ধূমপান বা তামাক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করাও হারাম। 

বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক, পি.জি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের রূপকার, প্রতিষ্ঠাতা এবং আধুনিক (আমরা ধূমপান নিবারন করি) এর প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় অধ্যাপক  ডাঃ নূরুল ইসলাম জনগণকে ধূমপান থেকে বিরত থাকার জন্য দেশব্যাপী কাজ করে গেছেন, যার ফলে ধূমপান অনেকাংশে কমেছে। তবে অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে এর প্রবণতা কমেনি। 

সম্প্রতি প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় দেখা গেল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা অর্থনৈতিক কষ্টে আছে, কারণ এটি একটি কুটির শিল্প, সিগারেটের মূল্য কম হওয়ায় সাধারণ গরীব শ্রেণীর মানুষ বিড়ির পরিবর্তে নিম্নমানের ও স্বল্পমূল্যের সিগারেটের দিকে ঝুকে পড়ায় বিড়ি আর চলছে না এবং শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের আর কাজ নেই। এদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছে এটা ঠিক, কিন্তু নিকোটিনের মত বিষ নিয়ে এরা নাড়াচাড়া করুক এটা সচেতন মহল মনে করেন না। সরকারের উচিৎ ঐ বিড়ি শিল্পকে উৎসাহিত না করে এ সকল গরীব মানুষের অন্যভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। “আমরা বুঝে সুজে করেছি বিষপান” এই তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।  

আমরা তামাকজাতদ্রব্য যাই বলিনা কেন, যেমন- বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, জর্দ্দা, গুল, দুকতা ইত্যাদি সবকিছুর মূলেই কিন্তু তামাক। সেই তামাক আর এখন শুধু রংপুরের হারাগাছায় নেই। টেকনাফ হতে তেতুলিয়া পর্যন্ত ছেয়ে গেছে, দেশ ছয়লাব হয়ে যাচ্ছে, সামান্য রাজস্ব আয়ের লোভে জাতিকে কোনভাবেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। এখনই সময়, চাষি ভাইদের বুঝিয়ে ব্যাংক ঋণসহ সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে তামাকের বিকল্প চাষের দিকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এমনিতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন, নদী ভাঙ্গন, উপক’লীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা ইত্যাদি কারণে চাষের জমি ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, এমন একটি স্পর্শকাতর অবস্থায় কোন মতেই তামাক চাষকে উৎসাহিত করা যায় না। সরকার কর্তৃক এর একটি সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন।

অতএব, সুস্থ্য, সুন্দর, ধূমপানমুক্ত ও তামাকমুক্ত সমাজ বা নতুন দেশ গড়তে হলে তামাক চাষ হ্রাসসহ নিচের স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হতে হবে- 

“এসো নেশা ছেড়ে কলম ধরি
তামাকমুক্ত নতুন এক সমাজ গড়ি।”

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের কার্যক্রম সফল হোক।

কলাম লেখক
অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান
প্রাক্তন অধ্যক্ষ
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ, ও
দর্শনা সরকারি কলেজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *