এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত কোন উত্তর নেই। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা আসলে সীমিত পরিসরে ধরা পড়ে না। আমরা শুধু এর পৃথক পৃথক ছবি তুলে ধরতে পারি। এই সব ছবিকে সমন্বয় করে বিজ্ঞানের একটি অখন্ডরূপকে ফুটিয়ে তোলা যায়। আদিম অসভ্য অসহায় মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখে বেশ ভীত হয়ে পড়ে। ফলে তার অপরিণত মনে জন্ম নেয় নানা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। একদিন নিজের সৃষ্ট সেই অন্ধ কাল্পনিক কাহিনীর মধ্যে মানুষ বন্দী হয়ে পড়ে। কালের পরিক্রমায় যখন মানুষ এই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ভেদ করে তার সন্ধানী মন প্রশ্ন করতে শুরু করে প্রকৃতির বিপর্যয় সম্পর্কে, তখনই রোপিত হয় বিজ্ঞানের বীজ। প্রাচীন যুগে এই প্রশ্ন করার কাজটি অত সহজ ছিল না। সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকে যে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা ছিল খুব বিপজ্জনক। মানুষের মনে সেই সময় মনস্তাত্ত্বিক জড়তাও ছিল তীব্র। তাই অন্ধবিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের সত্যের কোন মিল নেই। প্রাচীন ও মধ্যযুগে মানুষ বিশ্বাস করত যে সুর্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু প্রকৃত সত্য জানার আগে মানুষ প্রশ্ন উত্থাপন করে। বিজ্ঞানী এ্যারিস্টারকাস ও গ্যালিলিও ধাপে ধাপে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করার পর এখন গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথের আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানের এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে অনেক সাহসের দরকার হয়েছে।
ডারউইন মানুষের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ধারা আাবিস্কার করার পর ইউরোপে প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের ধারণা ভেঙ্গে পড়ে। সূতরাং আমরা বলতে পারি বিজ্ঞান এক ধরণের সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ।যা মানব জীবনকে বদলে দেয়। বিজ্ঞান আসলে প্রকৃতি সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ও সুবিন্যস্ত তথ্যের সমাহার। বিজ্ঞান আগে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি প্রকল্প বা ধারণা সৃষ্টি করে। এই প্রকল্পকে ব্যবহার করে একটি তত্ত্বকে দাঁড় করানো হয় এবং এই তত্ত্বের অবরোহী [ডিডাকটিভ] ফলকে [কার্য থেকে কারণ অনুমান করা] পরীক্ষা করে তার সত্যতা যাচাই করা হয়। এতে একটি নির্ভুল তথ্য পাওয়া যায়। শুধু তথ্য পাওয়া নয়, কী পদ্ধতিতে পাওয়া গেল সেটাও বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান অভিজ্ঞতা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যকে সাজিয়ে তত্ত্ব নির্মাণ করে। যেখানে বিজ্ঞানী তার অনুমান, সচেতন যুক্তি তর্ক বা স্বজ্ঞা[ইনটিউশন] ও যুক্তির বিন্যাস গাণিতিক মডেলকে ব্যবহার করে। এই তত্ত্বের প্রতিসাম্য [সামঞ্জস্য] বজায় রাখতে হয়। বিজ্ঞানের নির্মীয়মাণ তত্ত্ব বিশ্ব জগতের ছবি আঁকে বিজ্ঞানীর মনের মধ্যে। বিজ্ঞান তাই বিজ্ঞানীদের সৃষ্ট তত্ত্ব-নির্ভর বিশ্ব জগতের ধারণা।
বিজ্ঞানের প্রয়োগ নুতন উৎপাদন পদ্ধতির জন্ম দেয়। বিজ্ঞান তাই সমাজ কাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার হাতিয়ার। বিজ্ঞান প্রকৃতির নিয়ম আবিস্কারের ভেতর দিয়ে সমাজের মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে। নিউটনের বলবিদ্যার নিয়মকে ভিত্তি করে ইউরোপের সমাজ লাভ করে নিয়মতান্ত্রিকতা। ইউরোপের মানুষের মনে ডারউইনের তত্ত্ব বিপ্লব আনে আপন উদ্ভব সম্পর্কে।ফ্রয়েড আবিস্কার করেন মানুষের অবচেতন ও সচেতন মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। বিজ্ঞান শুধু মানুষের চিন্তার ফসল নয় তাঁর ভাবনাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য চিকিৎসা বস্ত্রহীন ও গৃহহীনের জন্য আবাসন-এসব মানব কল্যাণের জন্য বিজ্ঞান আর্শীবাদ হিসাবে কাজ করে। বিজ্ঞান আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে তোলে। প্রকৃতির সম্পদ নিষ্কাশনে বিজ্ঞানের জ্ঞান তাই অপরিহার্য। তাই বিজ্ঞান হলো সর্ব সাধারণের সম্পদ। বিজ্ঞানের সত্য যে কেউ যে কোন স্থান থেকে যে কোন সময় পরীক্ষা করে যাচাই করতে পারেন। বিজ্ঞানের প্রতিটি উদ্ভাবন ও আবিস্কার পর্যবেক্ষণ,পরীক্ষা ও যৌক্তিক চিন্তার ফসল। বিজ্ঞান ব্যক্তি বিশেষের পান্ডিত্য বা প্রজ্ঞার বাণী নয়। এটি সাধারণ মানুষের সম্পদ। বিজ্ঞানের সত্য ব্যক্তি নিরপেক্ষ। পরীক্ষা ও যুক্তি নির্ভর পদ্ধতির মধ্যেই এই নৈব্যক্তিকতা বিদ্যমান।
বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিস্কার আসলে প্রকৃতির এক একটি অন্তর্নিহিত প্রতিসাম্যকে প্রকাশ করে। তাই বিজ্ঞান আসলে সুন্দরের সাধনা। বিজ্ঞানের কোন তথ্যই পরম নয়। বিজ্ঞান এক অন্তহীন সংগ্রাম। বিজ্ঞান স্থান কাল ও ব্যক্তি নিরপেক্ষ সত্যের সন্ধান করে। বিশেষ দেশ, বিশেষ ভাষা ও বিশেষ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে বিজ্ঞানের সত্য সর্ব মানুষের সত্যে পরিণত হয়। বিজ্ঞানের ব্যবহৃত সংকেত, গাণিতিক সূত্র শ্রেণি বিভাগ ও বিশ্লেষণ যে ভাষাতেই প্রকাশিত হোক না কেন এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য ভাষা নিরপেক্ষ। নির্ভুলভাবে বিজ্ঞানের সত্যকে ভাষান্তরিত করা সম্ভব।
লেখক, জাহিদ হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা



