শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজন গ্রেফতার

আজকের চুয়াডাঙ্গা ডেস্ক

দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং পরিকল্পনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) ভোর ৫টা থেকে শুরু হওয়া কুষ্টিয়া ও হাতিরঝিলে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ৪৬ স্বতন্ত্র ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের একটি ইউনিট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সফলভাবে দুই জন শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং তাদের দুই জন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।’
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী, আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ এবং দুইজন শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি এবং ১ টি স্যাটেলাইট ফোন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়ার শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা রোডে সকাল সোয়া ৫টায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদকে। পরে তাদের দেওয়ার মতে ঢাকার হাতিরঝিল এলাকায় সকাল ৭টায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় শ্যুটার আরাফাত ও গাড়িচালক শরীফ। এই দুই শুটার আরাফাত ও গাড়িচালক শরীফ সুব্রত বাইনের সহযোগী।
কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, ‘এই চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা, চাঁদাবাজি এবং নাশকতা চালিয়ে আসছিল। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ হলো তালিকাভুক্ত ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী দলের অন্যতম নেতা এবং সেভেন স্টার চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী। এ অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং পরিকল্পনার ফসল। অপারেশনটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ক্ষয়ক্ষতি বা সংঘর্ষ ছাড়াই পরিচালিত হয় যা আমাদের বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ে ও সহায়তা দিয়েছে সেনা সদরের সামরিক অপারেশন পরিদপ্তর, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন, ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার বিগ্রেড, ৭১ মেকানাইজ বিগ্রেড ও এনএসআই।’
আইএসপিআর পরিচালক আরও বলেন, ‘এছাড়াও আমি আপনাদের মাধ্যমে দেশের জনগণকে জানাতে চাই- যেকোনো ধরনের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড কিংবা সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত তথ্য অনুগ্রহ করে নিকটস্থ সেনাক্যাম্প অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করুন। আমরা আবারও দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই- সেনাবাহিনী প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমালের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।’
কুষ্টিয়ার স্থানীয়রা জানায়, রোজার ঈদের পর পরই কুষ্টিয়ার পৌর শহরের কালিশংকরপুর এলাকায় তিন রুমে বাসা ভাড়া নেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ। মীর মহিউদ্দিনের তিনতলা বাড়ির নিচতলা ভাড়া নের তারা। ওই বাড়ির দোতলা ও তিনতলায় থাকেন ছাত্ররা। বাড়ির মালিক মীর মহিউদ্দিন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ছিলেন। তিনি মারা গেছেন। তিনতলা বাসার উপরের দুই তলায় মেস করে থাকেন কয়েকজন ছাত্র। ওই ছাত্রদের একজন ভাড়া তুলে বাড়ির মালিক মীর মহিউদ্দিনের স্বজনদের পাঠাতেন। তবে স্বজনরা এখানে আসতেন না।
রবিউল আলম নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘মীর মহিউদ্দিনের বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে কয়েকজন ব্যবসায়ী ভাড়া থাকেন। তাদের মালামাল রাখার জন্য একটি বাসা দরকার, এ কথা বলে বাসা নেন তারা। পরে তাদের দু’জন গেস্ট ভাড়া নেওয়া বাসায় থাকবেন বলে জানান ওই ব্যবসায়ীরা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আজ ভোরে যখন নামাজ আদায় করতে যাই, তখন পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছিল সেনাবাহিনী। তারা সবাইকে যে যার অবস্থানে থাকবে বলে। কয়েক ঘণ্টা ধরে তারা তল্লাশি চালায়। একপর্যায়ে একটি কালো রঙের মাইক্রো আসে। সেখানে চারজনকে তোলা হয়। দু’জনের কাছে ব্যাগ ছিল। একজনের হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো ছিল। অন্যজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।’
মেসের ভাড়া তোলার দায়িত্বে থাকা এক ছাত্র জানান, ‘পাশের বাসার ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিন ঘর ভাড়া নেওয়ার জন্য আসেন। এরপর হেলাল জানান, তার গেস্ট ওই বাসায় থাকবেন। এভাবে তারা বাসায় ওঠেন। ঘটনার পর হেলাল পলাতক আছেন। হেলালের বাড়িতে গেলে তার মা জানান, কেউ বাড়িতে নেই।’
মেসের ছাত্ররা জানান, ‘নিচতলায় কারা থাকতেন তা তারা জানতেন না। সুব্রত বাইনের মত একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী দুই মাস তাদের সঙ্গে থাকলেও তারা কোনোভাবেই টের পাননি। তবে মোল্লা মাসুদকে না চিনলেও তিনি তিনবেলা বের হতেন বাড়ি থেকে। পাশের একটি বাড়ি থেকে খাবার আনতেন মোল্লা মাসুদ। তবে কখনো তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতেন না।’
উল্লেখ্য, সুব্রত বাইন বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত অপরাধচক্র নেতা। তাকে সচরাচর ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে। ২০০৩ পর্যন্ত সুব্রত বাইন ছিলেন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র সেভেন স্টার গ্রুপের প্রধান। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে নামকরা সন্ত্রাসী হিসেবে সুব্রত বাইনের অভিষেক হয়। তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
২০০১ সালে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, সুব্রত বাইন তাদের অন্যতম। পুলিশের হাতে আটক হওয়া এড়াতে সে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *